- বইয়ের নামঃ গোলকধাম রহস্য
- লেখকের নামঃ সত্যজিৎ রায়
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই, ফেলুদা সমগ্র
০১. জয়দ্ৰথ কে ছিল
জয়দ্ৰথ কে ছিল?
দুর্যোধনের বোন দুঃশলার স্বামী। i
অস্ত্ৰ জরাসন্ধ?
মগধের রাজা।
ধৃষ্টদ্যুম্ন?
দ্ৰৌপদীর দাদা।
অর্জুন আর যুধিষ্ঠিরের শাঁখের নাম কী?
অৰ্জ্জুনের দেবদত্ত, যুধিষ্ঠিরের অনন্তবিজয়।
কোন অস্ত্ৰ ছুড়লে শত্রুরা মাথা গুলিয়ে সেমসাইড করে বসে?
ত্বাষ্ট্র!
ভেরি গুড!
যাক বাবা, পাশ করে গেছি! ইদানীং রামায়ণ-মহাভারত হল ফেলুদার যাকে বলে স্টেপল রিডিং। সেই সঙ্গে অবিশ্যি আমিও পড়ছি। আর তাতে কোনও আপশোস নেই। এ তো আর ওষুধ গেলা না, এ হল একধার থেকে ননস্টপ ভূরিভোজ। গল্পের পর গল্পের পর গল্প! ফেলুদা বলে ইংরেজিতে বইয়ের বাজারে আজকাল একটা বিশেষণ চালু হয়েছে—আনপুটডাউনেবুল। যে বই একবার পড়ব বলে পিক-আপ করলে আর পুট ডাউন করবার জো নেই। রামায়ণ-মহাভারত হল সেইরকম আনপুটডাউনেবল। ফেলুদার হাতে এখন কালীপ্রসন্ন সিংহের মহাভারতের দ্বিতীয় খণ্ড। আমারটা অবিশ্যি কিশোর সংস্করণ। লালমোহনবাবু বলেন, ওঁর নাকি কৃত্তিবাসী রামায়ণের অনেকখানি মুখস্থ, ওঁর ঠাকুমা পড়তেন, সেই শুনে শুনে মুখস্থ হয়ে গেছে। আমাদের বাড়িতে কৃত্তিবাসের রামায়ণ নেই; ভাবছি। একটা জোগাড় করে জটায়ুর স্মরণশক্তিটা পরীক্ষা করে দেখব। ভদ্রলোক আপাতত ঘরবন্দি অবস্থায় পুজোর উপন্যাস লিখছেন, তাই দেখা-সাক্ষাৎটা একটু কম।
বই থেকে মুখ তুলে রাস্তার দরজাটার দিকে চাইতে হল ফেলুদাকে। কলিং বেল বেজে উঠেছে। হিজলীতে একটা খুনের রহস্য সমাধান করে গত শুক্রবার ফিরেছে ফেলুদা। এখন আয়েশের মেজাজ, তাই বোধহয় বেলের শব্দে তেমন আগ্রহ দেখাল না। ও যা পারিশ্রমিক নেয় তাতে মাসে একটা করে কেস পেলেই ওর দিব্যি চলে যায়। জটায়ুর ভাষায় ফেলুদার জীবনযাত্রা সেন্ট পার্সেন্ট অনাড়ম্বর। এখানে বলে রাখি, জটায়ুর জিভের সামান্য জড়তার জন্য অনাড়ম্বরটা মাঝে মাঝে অনারম্বড়ি হয়ে যায়। সেটা শোধরাবার জন্য ফেলুদা ওঁকে একটা সেনটেন্স গড়গড় করে বলা অভ্যোস করতে বলেছিল; সেটা হল—বারো হাঁড়ি রাবাড়ি বড় বাড়াবাড়ি। ভদ্রলোক একবার বলতে গিয়েই চারবার হোঁচট খেয়ে গেলেন।
ফেলুদা বলে, নতুন চরিত্র যখন আসবে, তখন গোড়াতেই তার একটা মোটামুটি বর্ণনা দিয়ে দিবি। তুই না দিলে পাঠক নিজেই একটা চেহারা কল্পনা করে নেবে; তারপর হয়তো দেখবে যে তোর বর্ণনার সঙ্গে তার কল্পনার অনেক তফাত। তাই বলছি, ঘরে যিনি ঢুকলেন তাঁর রং ফরসা, হাইট আন্দাজ পাঁচ ফুট ন ইঞ্চি, বয়স পঞ্চাশ-টঞ্চাশ, কানের দুপাশের চুল পাকা, থুতনির মাঝখানে একটা আচিল, পরনে ছাই রঙের সাফারি সুট। ঘরে ঢুকে যেভাবে গলা খাঁকরালেন তাতে একটা ইতস্তক ভাব ফুটে ওঠে, আর খাঁকরানির সময় ডানহাতটা মুখের কাছে উঠে আসাতে মনে হল ভদ্রলোক একটু সাহেবভাবাপন্ন।
সরি, অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে আসতে পারিনি, সাফার এক পাশে বসে বললেন আগন্তুক— আমাদের ওদিকে রাস্তা খোঁড়াখুড়িতে লাইনগুলো সব ডেড।
ফেলুদা মাথা নাড়ল। খোঁড়াখুড়িতে শহরের কী অবস্থা সেটা আমাদের সকলেরই জানা আছে।
আমার নাম সুবীর দত্ত।—গলার স্বরে মনে হয় দিব্যি টেলিভিশনে খবর পড়তে পারেন। ইয়ে, আপনিই তো প্রাইভেট ইনভেস—
আজ্ঞে হ্যাঁ।
আমি এসেছি আমার দাদার ব্যাপারে।
ফেলুদা চুপ। মহাভারত বন্ধ অবস্থায় তার কোলের উপরে, তবে একটা বিশেষ জায়গায় আঙুল গোঁজা রয়েছে।
অবিশ্যি তার আগে আমার পরিচয়টা একটু দেওয়া দরকার। আমি করবেট অ্যান্ড নরিস কোম্পানিতে সেলস এগজিকিউটিভ। ক্যামাক স্ট্রিটের দীনেশ চৌধুরীকে বোধহয় আপনি চেনেন; উনি আমার কলেজের সহপাঠী ছিলেন।
দীনেশ চৌধুরী ফেলুদার একজন মক্কেল সেটা জানতাম।
আই সি ভীষণ সাহেবি কায়দায় গভীর গলায় বলল ফেলুদা। ভদ্রলোক এবার তাঁর দাদার কথায় চলে গেলেন—
দাদা এককালে বায়োকেমিস্ট্রিতে খুব নাম করেছিলেন। নীহার দত্ত। ভাইরাস নিয়ে রিসার্চ করছিলেন। এখানে নয়, আমেরিকায়। মিশিগ্যান ইউনিভার্সিটিতে। ল্যাবরেটরিতে কাজ করতে। করতে একটা এক্সপ্লোশন হয়। দাদার প্রাণ নিয়ে টানাটানি হয়; কিন্তু শেষে ওখানকারই হাসপাতালের এক ডাক্তার ওঁকে বাঁচিয়ে তোলে। তবে চোখ দুটোকে বাঁচানো যায়নি।
অন্ধ হয়ে যান?
অন্ধ। সেই অবস্থায় দাদা দেশে ফিরে আসেন। ওখানে থাকতেই একজন আমেরিকান মেয়েকে বিয়ে করেন; অ্যাক্সিডেন্টের পর মহিলা দাদাকে ছেড়ে চলে যান। তারপর আর দাদা বিয়ে করেননি।
তাঁর গবেষণাও তো তা হলে শেষ হয়নি? না। সেই দুঃখেই হয়তা দাদা প্রায় মাস ছয়েক কারওর সঙ্গে কথা বলেননি। আমরা ভেবেছিলাম হয়তো মাথা খারাপ হয়ে গেছে। শেষে ক্ৰমে মোটামুটি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসেন।
এখন কী অবস্থা?
বিজ্ঞানে এখনও উৎসাহ আছে সেটা বোঝা যায়। একটি ছেলেকে রেখেছেন—ওঁর হেলপার বা সেক্রেটারি বলতে পারেন—সেও বায়োকেমিষ্ট্রির ছাত্র ছিল—তার একটা কাজ হচ্ছে সায়েন্স ম্যাগাজিন থেকে প্ৰবন্ধ পড়ে শোনানো। এমনিতে যে দাদা একেবারে হেলপলেস তা নন; বিকেলে আমাদের বাড়ির ছাতে একই লাঠি হাতে পায়চারি করেন। এমনকী বাড়ির বাইরেও রাস্তার মোড় পর্যন্ত একাই মাঝে মাঝে হেঁটে আসেন। বাড়িতে এঘর ওঘর করার সময় ওঁর কোনও সাহায্যের দরকার হয় না।