- বইয়ের নামঃ গুহা
- লেখকের নামঃ সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
২. আজ খুব শীত
আজ খুব শীত। তোমার শীত করছে না? তুমি তো সমতলবাসী!
আপনিও তো কলকাতার মানুষ!
সে এক যুগ আগে। তখন তোমাদের ওখানে ডাক্তার বিধানচন্দ্রের কাল। তখন তুমি জন্মাওনি।
সে ঠিক।
তবে এখানে আপনার আশ্রয়ে, কৃপায় শীত সহ্য হয়ে গেছে।
তুমি আমাকে খুশি করার জন্যে বারে বারে কৃপা শব্দটা ব্যবহার করো, যেমন দাঁড়ে বসে চন্দনা না বুঝেই রাধা, রাধা, কৃষ্ণ, কৃষ্ণ করে। কৃপা কাকে বলে কোনও ধারণা আছে?
আছে! জীবনে সবচেয়ে খারাপ হওয়াটাই প্রকৃত কৃপা। ঘর, সংসার শেষ, আত্মীয়-স্বজন কেউ নেই। কপর্দকশূন্য ভিখারির দশা। প্রাণ থাকে কি যায়। বসে বসে দেখছি, মুচকি মুচকি হাসছি। মনে মনে ভাবছি, দেখি আরও কী হয়!
প্রতিরোধের চেষ্টা করবে না?
প্রতিরোধ তো একটাই, হাসিমুখে সহ্য করা। মারতে মারতে প্রহারকারী, দণ্ডদাতা ক্লান্ত। হাত থেকে চাবুক পড়ে গেল। যাকে প্রহার করা হচ্ছিল, সে এসে বলছে, প্রভু! কত কষ্ট হল আপনার? আসুন, আপনার সেবা করি। বাতাস করি।
সবই তোমার কেতাবে পড়া কথা। একটা অন্য দরজা দিয়ে বেরোবার চেষ্টা। বাস্তব অনেক বড়। সেখানে আমরা কীটপতঙ্গ। এসো, এই বটতলায় বসা যাক। সামনে গঙ্গা। এমন নদী পৃথিবীতে আর দুটো নেই। জীবনের প্রথম কথা, জীবনের শেষ কথা এই নদীতে। বোসো, বোসো। সূর্যের শেষ আলো।
জানেন তো গঙ্গা আমার কাছে বিষণ্ণ নদী। আমার বাবা, মা, ছোট বোন নৌকাডুবিতে মারা গেছে। একসঙ্গে তিনজন। অষ্টমীর উৎসবের রাতে। শেষ! বাড়ি খালি। আমি একা। চতুর্দিকে ছড়ানো স্মৃতি। বসে আছি প্রেতের মতো। এই সময় কারও দুষ্ট পরামর্শে একটি মেয়ে ঢুকে পড়ার চেষ্টা করল নানা ছলচাতুরী করে। মেয়েটি খারাপ ছিল না, তার মা ছিল সাংঘাতিক। দেখেশুনে এমন একজনকে বিয়ে করেছিল, যে বউয়ের কথায় ওঠে, বসে। আর একটু হলেই ফাঁদে পড়তুম। কুৎসা রটত। বেশ ভালো করে একটা তালা লাগিয়ে কেটে পড়লুম। এক জমিদারের ছেলেকে সেই সময় পড়াতুম। বড়লোক হলেও যথেষ্ট শিক্ষিত, ভালো মানুষ। বাড়িতে বিরাট লাইব্রেরি। সারাদিন পড়তেন। গবেষণামূলক প্রবন্ধ, বই লিখতেন। দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হয়ে আসছে। আমাকে বলতেন, তুমি রোজ আমাকে পড়ে শোনাবে। গঙ্গার ধারেই তাঁর বিরাট বাড়ি৷ যেদিকটা খুব নির্জন, সেই দিকের একটা ঘরে আমাকে থাকতে দিলেন। পশ্চিমে গঙ্গা, লাগোয়া বারান্দা। অনেক রাত পর্যন্ত বসে গঙ্গা দেখি। ওপারে একটা জুট মিল। কোয়ার্টার। আলোর সারি। হোরমিলার কোম্পানির স্টিমার কখনও কখনও এদিক। থেকে ওদিকে চলে যাচ্ছে। ভোঁ ভোঁ সিটি। থমথমে অন্ধকার রাত। স্টিমার কাটা ঢেউ ঘাটে আছড়ে পড়ছে। ছাৎ ছাৎ শব্দ। সেই সময় কেউ আমাকে ডাকত, বিমান, বিমান! চুপ করে বসে আছিস কেন? চলে আয়! কখনও কখনও এক লহমার জন্য আমার ওই ঘরে দেখতে পেতুম, গলায় দড়ি দিয়ে কে যেন ঝুলছে। ভূত-প্রেত আমি বিশ্বাস করি না। ভয় থেকেই ভূত জন্মায়। এই ব্যাপারটা আরও কিছুদূর এগোল। একদিন ভর সন্ধ্যাবেলা চুল এলো করে এক সুন্দরী তরুণী হঠাৎ ঘরে এসে ঢুকল। আমি কে, কে করে উঠলুম। গ্রাহ্যই করলে না। ওই এস্টেটের ম্যানেজার আমার থাকাটা পছন্দ করছিলেন না। ভাবলুম, ভদ্রলোক মেয়েটিকে
কায়দা করে ঘরে ঢুকিয়েছেন যাতে আমার নামে বদনাম রটানো যায়। ঘরে একটা লাঠি ছিল, সেইটা তুলতেই মেয়েটি অদৃশ্য হল। দরজা বন্ধ করে ফিরে তাকাতেই অবাক, মেয়েটি আমার খাটে বসে আছে। মাথায় খুন চেপে গেল। লাঠিটা তুলেছি। বসে থাকা অবস্থাতেই ধীরে ধীরে বাষ্পর মতো মিলিয়ে গেল। তখন আমি ভয় পেয়েছি। ওদিকে রাধা-গোবিন্দের মন্দিরে আরতি শুরু হয়েছে। কোনওদিন যাই না, সেদিন আমি প্রায় ছুটতে ছুটতে মন্দিরে গেলুম। গিয়ে দেখি বাড়ির মেয়েদের দলে মিশে ওই মেয়েটিও দাঁড়িয়ে আছে। ব্যাপারটা কী হল! মনের ভুল, চোখের ভুল! কাকে জিগ্যেস করব। বড়লোক, বিশাল বাড়ি। অহংকারী মেয়ের দল। ভুরু কুঁচকে তাকানো, ক্যাট ক্যাট কথা। ভীষণ, ভীষণ সুন্দরী। মহাসমস্যা! ওই ঘরে একা রাত কাটাবার সাহস আর নেই আমার। বাগানের মালি ভোলাদা আমার একমাত্র বন্ধু। পাঁচিলের ধারে গঙ্গার দিকে লতায়পাতায়-ঘেরা একটা চালায় থাকে। ভোলাদাকে। বললুম, ভোলাদা…। সব শুনল। বললে, আছে। সে আসে। কী একটা বলতে চায়। এই সব বড় বড় বাড়িতে কত কাণ্ড ঘটে গেছে! আরও কত ঘটবে ভাই! ঠিক আছে, আমি তোমার ঘরে শোবো। আমার কিন্তু নাক ডাকে!
তোমার এই জীবনকাহিনির মধ্যে নতুন কি আছে? সেই এক গল্প!
আছে। আর একটু এগোলেই আছে। আমার মন বললে, একটা খুন হয়েছিল এখানে। বেপাত্তা হয়ে গিয়েছিল একজন। কে সে? কী বলা হয়েছিল তখন? পাঁচিলের বাইরে দক্ষিণদিকে পুরোহিতের পরিবার। তিনটে চালা। উঠান। বটের ছায়া। বকুল, কদম, চাঁপা। সাধারণ ঘন্টানাড়া পুরোহিত নন। পণ্ডিত। মুখোপাধ্যায় বংশ। পূর্বপুরুষ ভাটপাড়ায়। এসেছিল কান্যকুজ থেকে সেই কবে। আমি রোজ সংস্কৃত পড়তে যাই। খুব স্নেহ করতেন।
তাঁর সুন্দরী একটি মেয়ে ছিল। বয়স সতেরো। কালো কুচকুচে চুলে এতখানি একটা খোঁপা। ঝিনুকের মতো কপাল, লাল করমচার মতো ঠোঁট। সুঠাম দেহ। মাখনের মতো শরীর। উন্নত স্তন। মরালগ্রীব। যখন চলে যায়…।