- বইয়ের নামঃ শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের গল্প
- লেখকের নামঃ শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
অনুভব
সামনের বারান্দায় বসে খবরের কাগজ পড়তে পড়তেই হৃদয়ের সূক্ষ্ম ইন্দ্রিয়জ অনুভূতি কাজ করল। কাগজটা মুখ থেকে সরিয়ে দোতলার বারান্দা থেকে নীচের মাঝারি চওড়া রাস্তার দিকে চেয়ে সে দেখল তার ছেলে মনীশ, নাতি অঞ্জন আর পুত্রবধূ শিমুল আসছে। দৃশ্যটি এই শরতের মেঘভাঙা উজ্জ্বল সোনালি রোদে ভারী চমৎকার দেখাচ্ছে। মনীশের পরনে গাঢ় বাদামি রঙের চৌখুপিওলা ঝকঝকে পাতলুম, গায়ে হালকা গোলাপি জলছাপওলা হাওয়াই শার্ট। লম্বাটে গড়নের, ফরসা ও মোটামুটি স্বাস্থ্যবান মনীশকে বেশ তাজা ও খুশি দেখাচ্ছে। রাতে নিশ্চয়ই খুব ভালো ঘুমিয়েছে, স্ত্রীর সঙ্গে ঝগড়া হয়নি এবং হাতে কিছু বাড়তি টাকা আছে। নাতির পরনে নীল চৌখুপি এবং ডোনাল্ড ডাকওলা বাবা সুট, শিমুলের শ্যামলা ছিপছিপে শরীরে আঁট হয়ে পেঁচিয়ে উঠেছে একটা বিশুদ্ধ দক্ষিণী রেশমের কাঁচা হলুদ রঙের চওড়া কালোপেড়ে শাড়ি।
দৃশ্যটা চমক্কার। মনীশের হাতে সন্দেশের বাক্স। শিমুলের কাঁধ থেকে ব্যাগ ঝুলছে। আজ রবিবার, ওরা সারাদিন থাকবে, সন্ধের পর বন্ডেল রোডের ফ্ল্যাটে ফিরে যাবে। মনীশ বাবাকে দেখতে পেয়ে হাত তুলে চেনা দিল। হৃদয়ও হাত তোলে। তারপর নিস্পৃহ হয়ে আবার ইজিচেয়ারে পিছনে হেলে বসে খবরের কাগজের দিকে তাকায়।
কিন্তু খবরের কাগজ পড়ে না হৃদয়। সে বসে তার সূক্ষ্ম ইন্দ্রিয়জ অনুভূতি বা ইনস্টিংকট-এর কথা ভাবতে থাকে। এই যে খবরের কাগজ পড়তে-পড়তে হঠাৎ মনের মধ্যে একটা ইশারা জেগে উঠল আর হৃদয় দোতলার বারান্দা থেকে রাস্তায় তাকিয়ে দেখল সপরিবারে তার ছেলে আসছে, এ ব্যাপারটা তাকে বেশ খুশি করে। এমন নয় যে ছেলেকে দেখে তার আনন্দ হয়েছে। বরং এই এ রবিবারের আগন্তুক মনীশকে সে খুব একটা পছন্দ করে না। ওর বউ শিমুলকে আরও নয়। মনীশের বয়স এখন বছর-পঁচিশেক হবে, হৃদয়ের ধারণা শিমুলের বয়স মনীশের চেয়ে অন্তত বছর দুই-তিন বেশি। নাতি অঞ্জনকে এমনিতে খারাপ লাগে না হৃদয়ের, তবে তার বাপ-মা তাকে নিয়ে এত ব্যস্ত এবং সতর্ক যে হৃদয় তার সম্পর্কে খুব আগ্রহ বোধ করে না আজকাল। একটু ক্যাডবেরি কি সন্দেশ হাতে দিলেও অঞ্জনের বাপ-মা সমস্বরে ‘ওয়ার্মস ওয়ার্মর্স’ বলে আঁতকে ওঠে। আরে বাবা, কৃমি কোন বাচ্চার নেই? তা বলে কি বাচ্চারা মিষ্টি খাচ্ছে না? অন্য কেউ স্নান করালে নাকি ছেলের ঠান্ডা লাগে বলে শিমুলের ধারণা। এ বাড়িতে এসেই ছেলের জন্য শিমুল ফি রবিবার হাফ বয়েল্ড ডিম আর সবজির স্টু বানানোর বায়না। ধরবে। অত যত্নের ছেলেকে ছুঁতে একটু ভয় করে হৃদয়ের। আর ভয় করলে ভালোবাসা বা। স্নেহটা কিছুতেই আসতে চায় না।
কিন্তু হৃদয় তার ছেলে এবং ছেলের পরিবারকে দেখে খুশি হোক বা না হোক, এই প্রায় পঞ্চাশ বছরের কাছাকাছি বয়সে নিজের সূক্ষ্ম বোধশক্তি দেখে কিছু তৃপ্তি পেয়েছে। বলতে কী, এই ইনস্টিংকট যে তার আছে এ বিষয়ে বরাবর সে নিঃসন্দেহ ছিল। সেবার জামসেদপুর যাওয়ার সময় তার কামরায় টিটি একটা বিনা টিকিটের ছোকরাকে ধরেছিল। ছোকরা বারবার তার এ পকেট ও পকেট খুঁজে রাজ্যের কাগজপত্র, নোটবই রুমাল খুঁজে-খুঁজে হয়রান। বলছে—টিকিটটা ছিল তো! পকেটেই রেখেছিলুম! কেউ বিশ্বাস করছিল না অবশ্য। টিটি তাকে বাগনানে নামিয়ে জি আর পি-তে দিয়ে দেবে বলে শাসাচ্ছে। ছোকরা তখন হৃদয়ের দিকে চেয়ে সাদা মুখে বলেছিল—দাদা, ঝাড়গ্রাম স্টেশনের কাছেই আমার দোকান, আমার ভাড়াটা দিয়ে দিন, আমি ঝাড়গ্রামে নেমে ছুটে গিয়ে টাকা এনে দিয়ে দেবে আপনাকে। হৃদয়ের ইনস্টিংকট তখনই বলেছিল যে, এ-ছোকরা মিথ্যে বলছে না। চোখে মুখে সরল সত্যবাদিতার ছাপ ছিল তার। টিকিটও হয়তো কেটেছিল। কিন্তু ইনস্টিংকটকে উপেক্ষা করেছিল হৃদয়। ভেবেছিল, যদি আহাম্মকের মতো ঠকে যাই? পরে অবশ্য ছোকরা সে-কামরাতেই খুঁজে পেতে তার ঝাড়গ্রামের চেনা লোক বের করে ভাড়া মিটিয়ে দেয় এবং হৃদয়ের কাছে এসে এক গাল সরল হাসি হেসে বলে—দাদা, পেয়ে গেছি। শুনে মনটা বড় খারাপ হয়ে গিয়েছিল হৃদয়ের। সে তো জানত, মুখ দেখেই তার সূক্ষ্ম অনুভূতিবলে টের পেয়েছিল, ছোকরা মিছে কথা বলছিল না। তার সেটুকু উপকার সেদিন করতে পারলে আজ এই সুন্দর সকালের সোনালি রোদটুকুকে আর একটু বেশি উজ্জ্বল লাগত না কি তার কাছে।
ওরা দোতলায় উঠে এসেছে টের পাচ্ছিল হৃদয়। তার বউ কাজল দরজা খুলে নানারকম অভ্যর্থনা ও আনন্দের শব্দ করছে। করবেই। ছেলেমেয়েদের মধ্যে এই মনীশই যা একটু-আধটু আসে। আর সবাই দূরে। মেজো ছেলে অনীশ আমেরিকায়, ছোট ক্ষৌণীশ তার মেজদার পাঠানো টাকায় দেরাদুনে মিলিটারি অ্যাকাডেমিতে পড়ছে। একমাত্র মেয়ে অর্পিতা বোম্বাইয়ে স্বামীর ঘর করে। এ- বাসায় কাজল আর হৃদয়, হৃদয় আর কাজল। শুনতে বেশ। কিন্তু আসলে যৌবনের সেই প্রথমকাল থেকেই কোনওদিন কাজলের সঙ্গে বনল না হৃদয়ের। ফুলশয্যার রাতেই কাজল প্রথম আলাপের সময় বলেছিল—আমি কিন্তু গানের ক্ষতি করতে পারব না তাতে সংসার ভেসে যায় যাক। তখনই হৃদয়ের ইনস্টিংকট বলেছিল—একথাটা এই রাতে না বললেও পারত কাজল। বিয়েটা হয়তো সুখের হবে না।