- বইয়ের নামঃ কাপুরুষ
- লেখকের নামঃ শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
- প্রকাশনাঃ আনন্দ পাবলিশার্স (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
০১. ওই চলেছে দুঃখী দেবীলাল
ওই চলেছে দুঃখী দেবীলাল তার পুঁটুলিটি কাঁধে নিয়ে। ওই পুঁটুলির ভিতরে আছে কাঠকয়লার উনুন, চিমটে, ছোট্ট বড় বাটালি, সীসের ডেলা। কে আর রোজ রোজ বাসনকোসন ঝালাই করায় বাবা! সারাদিনে কয়েকটা পয়সা মাত্র আয়। দেবীলাল চলেছে মাঠের ভিতর দিয়ে। ওই মাঠে এখন অজস্র প্রজাপতি ঘুরে বেড়াচ্ছে। এ যেন প্রজাপতির মরশুম। দেবীলাল না মাড়িয়ে দেয় প্রজাপতির ফিনফিনে পাখনা।
কী করে যে মনের কথা টের পেল দেবীলাল কে জানে। মুখটা ফিরিয়ে বলল, আমি কখনও কারও ক্ষতি করিনি, বুঝলে খোকা! তবু ভগবান দিলেন না।
ভগবান কত কী দেন না। আবার কত কী দেনও। সে তো রোজ শোনে, তারা বড় গরিব। বড়ই গরিব। তবু ভগবান তাকে কত কী দেন। আকাশ-ভরা সোনার আলো, আকাশ-ভরা তারা, চারদিকে কত দুর দুর ছড়ানো দিগন্ত, মাঠ-ভরা প্রজাপতি, গাছে পাকা কামরাঙা, লাল ঘুড়ি, ভুলোর মতো বাধ্যের কুকুর। ভগবান না দিলে কি সে পেত তার অত ভাল মাকে!
দুঃখী দেবীলাল একটু কোলকুঁজো হয়ে সবুজ ঘাসের ওপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। প্রজাপতি ঘিরে ধরেছে তাকে। দেবীলাল দেখছে না, মানুষ কত কী দেখে না! জ্যোৎস্নার রাতে যখন এই মাঠে পরিরা নেমে আসে তখন কেউ দেখতে পায় না। যখন অন্ধকার রাতে হলধর ভূত আর জলধর ভূতে এখানে লড়াই হয় তখনও কেউ দেখতে পায় না। কিন্তু যখন কাদুয়া চোরকে মাঝে মাঝে বেঁধে এনে বাঁশ দিয়ে পেটানো হয় তখন কত লোক দেখতে আসে। সেই অমানুষিক মার চোখ চেয়ে দেখতে পারে না সে, কিন্তু কত মানুষ হেসে হররা করে। মারের পরও কাদুয়াকে সারাদিন গোলপোস্টের সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়। খাবার পায় না, জল পায় না। কিন্তু সন্ধেবেলা ঠিক দেখা যায়, সে পটলের দোকানের বেঞ্চে বসে দিব্যি বিড়ি ফুঁকছে।
সে একদিন জিজ্ঞেস করেছিল, কাদুয়াদা, তোমার লাগে না?
কাদুয়া ঝা বাবুদের মোষের জন্য হাঁসুয়া দিয়ে ঘাস কাটছিল। বলল, লাগে। তবে কিনা আমার হল টাইট শরীর।
টাইট শরীর কাকে বলে তা অবশ্য স্পষ্টভাবে জানে না সে। তবে তার খুব ইচ্ছে করে সে যখন বড় হবে তখন তার শরীরটাও যেন টাইট হয়।
লম্বা একটি ঘাসের ডাঁটি বেয়ে বেয়ে একটা কালো পিঁপড়ে কেন খামোখা উঠছে কে জানে। কিন্তু বিশু খুব নিবিষ্টভাবে লক্ষ করে দৃশ্যটা আর আশ্চর্য হয়ে ভাবে, এই ছোট্ট ঘটনাটা সে ছাড়া পৃথিবীর আর কেউ জানে না। কেউ জানে না, কেউ টের পাচ্ছে না, কেউ দেখছে না যে, মস্ত মাঠের অগুন্তি ঘাসের উঁটির একটিতে একটা বোকা পিঁপড়ে ধীরে ধীরে উঠছে। উঠল, চারদিক বুঝি চেয়ে দেখল একটু, তারপর ফের নামতে লাগল। কী মিষ্টি, বোকা, ছোট্ট একটু ঘটনা। পিঁপড়েরা মাঝে মাঝে এমনি মিছিমিছি পরিশ্রম করে।
এইরকম কত কী ঘটে যায়, যা পৃথিবীর আর কেউ দেখে না, জানেও না। শুধু বিশু জানে। একা বিশু। কেষ্টদের বাড়ির পিছনের কচুবনে একখানা আধুলি পড়ে আছে কবে থেকে, কেউ কি জানে! বিশু কখনও পয়সা কুড়োয় না। তার দাদু বলেন, পয়সা কুড়োলে যা কুড়োবি তার দশগুণ তোর ঘর থেকে বেরিয়ে যাবে। কুড়োয় না ঠিকই, তবে মাঝে মাঝে সে গিয়ে আধুলিটাকে দেখে আসে। একটা লজ্জাবতী লতার ঝুপসি ছায়ায় পড়ে আছে। তাকে দেখলেই করুণ নয়নে চেয়ে আধুলিটা বলতে চায়, নাও না আমায়।
কেউ জানে না, নলিনী স্যারকে সাঁঝবাজার থেকে ফেরার পথে এক সন্ধেবেলা কানাওলা। ভূতে ধরেছিল। কানাওলা ধরলে কিছুতেই আর চেনা পথ খুঁজে পাওয়া যায় না। কেবল, বেভুল ঘুরে ঘুরে মরতে হয়। হাটখোলার কাছে স্যার তাকে দেখে বললেন, খোকা, একখান কথা শুনবা? আমারে মনে লয় কানাওলায় ধঅরছে। আমারে তুমি চিনতে পারতাছো ত’! আমার লগে লগে গিয়া আমারে বাড়ি পর্যন্ত একটু আউগাইয়া দিবা? কাউরে কিন্তু ঘটনাটা কইয়ো না।
বলেওনি বিশু। শুধু সে জানে, আর স্যার। আর কেউ নয়।
সেদিন নিঝুম দুপুরে রুকুদিদি যখন পেয়ারাগাছের নীচে বসে গোল কাঠের ফ্রেমে একখানা কাপড় আটকে সুতোয় ডিজাইন তুলছিল তখন টেরও পায়নি তার বেণী বেয়ে বেয়ে উঠছিল একটা কাঠপিঁপড়ে। পিঁপড়েটার পেটটা লাল, আর দু’দিক কালো। কামড়ে সাংঘাতিক জ্বালা। রুকুদি বিভোর হয়ে একখানা কী সুন্দর যে লতাপাতা ফুলের ছবি তুলছিল রঙিন সুতোয়। ওই তন্ময় ভাব কাটিয়ে দিলে রুকুদি খুব চমকে যাবে। তাই বিশু পিঁপড়েটাকে আলতো চিমটিতে ধরে ফেলে দিল। আর তখনই কুটুস করে কামড়াল পিঁপড়েটা। চোখে জল এসে গিয়েছিল বিশুর। কিন্তু রুকুদি তো জানল না, কেউ তো জানল না। শুধু সে জানল, আর পিঁপড়েটা।
ভগবান কত কী দেন না মানুষকে। এই যেমন রুকুদিদির বাবাকে ভগবান একটাও ছেলে দিলেন না। দিলেন শুধুই মেয়ে। সাত-সাতটা মেয়ে। রুকুদিরা সাত বোন। রুকুদির বাবা অঘোরবাবু প্রায়ই দুঃখ করে বলেন, আমার সাতটা মেয়েই ভাল, যেমন লেখাপড়ায়, তেমনি স্বভাবচরিত্রে, তেমনি কাজেকর্মে, তেমনি সেবায়। কিন্তু তা বলে ওদের একটা ভাই থাকবে না? ভগবানের এটা কেমন অবিচার?
একদিন রুকুদি দুঃখ করে বিশুকে বলেছিল, আমরা জন্মে বাবার দুঃখই বাড়িয়ে দিয়েছি। কেন যে জন্মালাম!হা রে, এমন কোনও ওষুধ পাওয়া যায় না যা খেলে মেয়ে থেকে ছেলে হয়ে যাওয়া যায়? আমার খুব ছেলে হয়ে যেতে ইচ্ছে করে।