- বইয়ের নামঃ বাসস্টপে কেউ নেই
- লেখকের নামঃ শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
- প্রকাশনাঃ আনন্দ পাবলিশার্স (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
০১. ঘুমচোখে নিজের ঘর থেকে বেরোবার মুখে
ঘুমচোখে নিজের ঘর থেকে বেরোবার মুখে পাশের ঘরের পর্দাটা সাবধানে সরিয়ে রবি তার বাবাকে দেখতে পায়। খোলা স্টেটসম্যানের আড়াল থেকে ধোঁয়া উঠছে, আর সামনে একটা ক্ষুদে টেবিলের ওপর এক জোড়া পা, পায়ের পাশে একটা গরম কফির কাপ। ওই স্টেটসম্যান, পা আর কফির কাপ–ওই তার বাবা। রবি প্যান্টের পকেটে হাত ভরে রিভলভারটা বের করে আনল। সেটা তুলল, এক চোখ ছোট করে লক্ষ্যস্থির করল। তারপর টিপল ট্রিগার।
ঠিসুং…ঠিসুং…ঠিসুং…তিনটে বুলেট ছুটে গেল চোখের নিমেষে। স্টেটসম্যানটা খসে পড়ে যায় প্রথমে, দামি স্প্রিংয়ের ওপর দুর্ধর্ষ নরম ফোম রবারের গদির ওপর ঢলে পড়ে যায় বাবা, গদির ওপর দুলতে থাকে শরীর। বাবা চমৎকার একটা মৃত্যু চিৎকার দেয়— আ আ আ আ…..
রবি হাসে একটু। রিভলভারটা আবার পকেটে ভরে দু পা এগোয়, তার বাবা দেবাশিস শুয়ে থেকেই তার দিকে চেয়ে বলে, শট! শট!
রবির ঘুমমাখা কচি মুখে চাপা রহস্যময় হাসি। বলে, নাইস অব ইউ টেলিং দ্যাট।
দেবাশিস উঠে বসে। জ্বলন্ত সিগারেটটা ঠোঁটে নেয়। স্টেটসম্যানটা দিয়ে মুখ ঢাকার আগে বলে, প্রসিড টুওয়ার্ডস দা বাথরুম ম্যান।
ইয়া। বলে রবি হাই তোলে। ডাকে— দিদি!
অমনি অন্য পাশের ঘরের পর্দা সরিয়ে আধবুড়ি ঝি চাঁপার হাসিমুখ উকি দেয়— সোনা। দুহাত বাড়িয়ে রবি ঘুমন্ত গলায় বলে, কোল।
চাঁপা তাকে কোলে নেয়। এই সকালের প্রথম বাথরুমে যাওয়াটা বড় অপছন্দ রবির। একটু সময় সে দিদির কোলে উঠে থাকে রোজ সকালে কাঁধে মাথা রেখে হাই তোলে।
চাঁপা কানে কানে বলে, আজ রবিবার।
হুঁ।
ছুটি।
ইয়া।
সোনাবাবু আজ কোথায় কোথায় যাবে বাবার সঙ্গে?
কচি মুখখানা একরকম সুস্বাদু হাসিতে ভরে যায় রবির। প্রকাণ্ড শার্দিওলা চওড়া জানালার কাছে এসে চাঁপা পর্দা সরিয়ে দেয়। সাত তলার ওপর থেকে বিশাল কলকাতার দৃশ্য ছবির মতো জেগে ওঠে। নীচে একটা মস্ত পার্ক। পার্কের মাঝখানে পুকুর। চারধারে বাঁধানো রাস্তায় লোজন হাঁটছে।
ও ঘরে টেলিফোন বাজে, রিসিভার তুলে নেওয়ার ‘কিট’ শব্দ হয়। তারপর দেবাশিসের স্বর হ্যালো।
রবি বলে, ফোন।
চাঁপা বলে, হুঁ।
কার ফোন বলল তো?
বাবার বন্ধু কেউ!
না, মণিমার। রবি বলে।
চাঁপার মুখখানা একটু গভীর হয়ে যায়। বলে, এবার চলো, মুখখানা ধুয়ে নেবে।
রবি হাই তোলে, বলে, কাল রাতের গল্পটা শেষ করোনি।
চাঁপা হাসে–বলব। দাঁত মাজতে মাজতে।
ও ঘর থেকে দেবাশিসের হাসির শব্দ আসে। বলে, আজই? …হুঁ…হুঁ…না, না, রবিবার শুধু রবির দিন। এ দিনটা ওর সঙ্গে কাটাই।…আচ্ছা…।
রবি উৎকর্ণ হয়ে শোনে। বলে, ঠিক মণিমা।
এখন চলো তো। চাঁপা বলে।
বাথরুমে দাঁড়িয়ে পেচ্ছাপ করতে করতে হাই তোলে রবি। চাঁপা তার ছোট্ট ব্রাশে পেস্ট লাগাতে যাচ্ছিল, রবি রাগের স্বরে বলে, না, না পেস্ট না!
তবে কী দিয়ে মাজবে?
তোমার কালো মাজনটা দিয়ে।
ও তো ঝাল মাজন! পেস্ট মিষ্টি।
না, পেস্ট বিচ্ছিরি। ফেনা হলে আমার বমি পায়।
বাবা যদি টের পায় আমার মাজন দিয়ে মেজেছ তা হলে রাগ করবে কিন্তু।
টের পাবে কী করে! চুপ চুপ করে মেজে দাও। আঙুল দিয়ে কিন্তু। ব্রাশ বিচ্ছিরি।
চাঁপার বুড়ো মুখখানা মায়ার হাসিতে ভরে ওঠে। সে রান্নাঘর থেকে তার সস্তা কালো মাজনের শিশি নিয়ে এসে দাঁত মেজে দিতে থাকে।
রবি ভ্রূ কুঁচকে বলে, গল্পটা বলবে না?
হ্যাঁ হ্যাঁ তারপর…কতটা যেন বলেছিলাম সোনাবাবু?
তোমার কিছু মনে থাকে না। শিবুচরণ রাত্তির বেলা একা মাছ ধরতে গিয়েছিল নৌকোয়। জাল টেনে তুলতেই দেখে মাছের সঙ্গে একটা কেউটে সাপ।
হ্যাঁ হ্যাঁ লালটেমের আলোয় জাল খুলতেই মাছের সঙ্গে একটা কেউটে সাপ বেরিয়ে এল। ছোট্ট নৌকো, চার হাত খানেক হবে। তার এধারে শিবুচরণ হাঁ করে দাঁড়িয়ে, মাঝখানে লালটেম জ্বলছে, ওধারে ফণা তুলে কালকেউটে। আর খোলের মধ্যে জ্যান্ত মাছগুলো তখনও দাপাচ্ছে। চারধারে কালিঢালা অন্ধকার নিশুত নিঃঝুম। মাঝগাঙে শিবুচরণের সে কী বিপদ! নড়তে চড়তে পারে না, ভয় বুদ্ধিভ্রংশ হাতে পায়ে সাড়া নেই।
রবি প্রথম কুলকুচোটা সেরে নিয়েই বলে, জলে ঝাঁপ দিল না কেন?
চাঁপা একটু খতিয়ে গিয়ে বড় বড় চোখ করে চায়— ঠিক তত সোনাবাবু! কী বুদ্ধি বাবা তোমার ওইটুকুন মাথায়! উঃ!
বলে চাঁপা রবির মুখ তোয়ালে দিয়ে মুছিয়ে কোলে তুলে নেয়। মাথাটা কাঁধে চেপে রেখে বলে, সোনাবাবুর মাথার মধ্যে বুদ্ধির বাসা। এমনটি আর দেখিনি।
রবি মুখ টিপে অহংকারের হাসি হেসে মুখ লুকিয়ে বলে, উঃ তারপর বলো না!
হ্যাঁ, তা শিবুচরণের হাতে পায়ে তো খিল ধরে গেছে তখন। কাঁপুনি উঠছে। ভাবছে এই মলুম, এই গেলুম আর বাপভাই ছানাপোনার মুখগুলো দেখতে পাব না। কালসাপে খেলে আমাকে গো! কে কোথায় আছ মানুষজন, এসে পরাণটা রাখো। কিন্তু কোথায় কে! শীতের মাঝরাতে মাঝগাঙে জনমনিষ্যি নেই। শিবুচরণ বুঝল যে মানুষজনকে ডাকা বৃথা। কেউ তার ডাক শুনতে পাবে না। তখন ভয়ের চোটে শিবু রামনাম করতে থাকে, কিন্তু সাপটা নড়ে না। শিবুর মনে হল, তাই তো রামনাম তো ভূতের মন্ত্র। তখন সে মা মনসাকে ডাকতে থাকল। তাতে যেন আরও জো পেয়ে সাপটা এধার ওধার গোটা-দুই ছোবল মারল। লালটেমটা মাঝখানে থাকতে রক্ষে। কিন্তু সে আর কতক্ষণ। শিবু বুঝে গেল মা মনসা কুপিত আছেন কোনও কারণে তার ওপর। ডেকে কাজ হবে না হিতে বিপরীত হয় যদি! তখন শিবুচরণ মনে করল গাঁয়ের পুরুতমশাই বলেন বটে বাপ পিতেমোর আত্মা…সোনাবাবু বোসো।