- বইয়ের নামঃ ফজল আলী আসছে
- লেখকের নামঃ শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
- প্রকাশনাঃ আনন্দ পাবলিশার্স (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
০১. বাপটা খায়
০১.
বাপটা খায়। রোজ নয়, মাঝে মাঝে। দুদিন ফাঁক দিয়ে হয়তো তিন দিনের দিন সাঁঝবেলায় এক পেট ঝঝ খিদে নিয়ে হাজির। সবদিন তা বলে ভরপেট দেওয়া যায় না। বায়নাক্কা নেই অবশ্য। রুটি গুড় দিল তো তা-ই সই। নইলে আধভাঙা গম আর কুখিক-লাইয়ের খিচুড়ি, নয়তো গম ভাজা, নিদেন কিছু আটা জলে গুলে ছাতু মাখার মতো খেয়ে ওঠে।
ছেলে হরিপদ ভাবে, বাপ আমারটা খায়। তার আগের পক্ষের বউও ভাবে, শ্বশুর আমাদেরটা খায়। ভাবলেই হল। মানুষ যা-ই ভাবে তার কাছে দুনিয়াটা সেইমতো।
বাপ হরিদেব নিজে কিন্তু ভেবে পায় না যে সে কারটা খায়। কোথায় খায়, হাগে, মোতে, কোথায় শোয়, এ তার মনেও থাকে না তেমন।
কারটা সে খায় এইটে হরিদেব আজ ভাবছিল। ভাবত না যদি না ছোট ছেলে নিত্যপদ দশ পয়সার মুড়ি লজেফুস কিনে বাপকে বলত, একটু খাবে বাবা? ভিতরে মৌরি দেওয়া আছে। ওপরের মিষ্টিটা চুষে খেলে মৌরিটা বেরিয়ে পড়ে। তখন চিবিয়ে।
হরিদেব ভারী অবাক হয়ে দেখে জিনিসটা। হাত পেতে নেয়ও। মুড়ি লজেশই বটে। এক্কেবারে হুবহু মুড়ির মতো দেখতে, তবে নানা রঙের। হাতে নিয়েও খেল না, নিত্যকে ফিরিয়ে দিয়ে বলল, তুই খা। পয়সা পেলি কোথায়?
চুরি করিনি, মা দিয়েছে।
তোর মা এয়েছিল আজ?
আসবে না তো কী! আজ দাদার বিয়ে না? দুপুর থেকে এসে বসে আছে।
তা বটে, হরিদেবের মনে পড়ে গেল। তাই তো! আজ তার ছেলে হরিপদর বিয়ে। মনে থাকে না। মনের আর দোষ কী? হরিপদ এত ঘন ঘন বিয়ে করে যে তাল রাখা মুশকিল। কপালটাই। খারাপ ছেলেটার। বউ থাকে না। গত চার বছরে এই নিয়ে–
কতবার হল রে নেত্য?
কী?
বিয়ে?
তিন।
কোন বউটা সবচেয়ে ভাল ছিল?
গেলবারেরটা। ফটর ফটর কথা কইত খুব, ফরসা ছিল।
সেইটেই সবচেয়ে বেশি দিন ছিল, না?
না, প্রথম মাগিটাই বেশি দিন ছিল।
ন’ বছরের ছেলের মুখে মাগি শুনে হরিদেব ভাবল, একটা ধমক দেয়! তারপর ভাবে, যাক গে, যাক গে, যাক গে বাবা! মুখ ফসকে কত ওরকম বেরোয়।
এই দেখো মৌরি।—বলে নিত্য জিভ বের করে দেখায়।
হরিদেব দেখে, বাস্তবিকই ছেলের জিভে তিন চারটে চোপসানো মৌরি। ফোকলা মুখে হরিদেব হাসে। বলে বাঃ বাঃ!
হরিদেব ভাবল, আজ আমার ছেলের বিয়ে। অা? ছেলের বিয়ে ভেবে সে বেশ একটু দেমাক বোধ করে। ছেলের বিয়ে’ কথাটার মধ্যে একটা ভারভাত্তিক ব্যাপার আছে।
বিয়েতে অবশ্য হরিদেবের নেমন্তন্ন হয়নি। তা সে আগেরবারে বা তার আগেরবারেও হয়নি। প্রথমবারের বিয়েতে টুনি বালব জ্বেলে বাহার দিয়ে আসর সাজিয়েছিল ছেলে। জনা পঞ্চাশেক লোক খেলা হরিদেবকে বলেনি বলে সে গদাধরবাবুদের বাড়ির চালাঘরের গুদামে খাটিয়া বিছানায় গুম হয়ে পড়েছিল। অনেক রাতে হরিপদ নিজেই কলাপাতায় মুড়ে ভাত, মাংস, চাটনি আর দরবেশের একটা দলা নিয়ে বাপকে ঠেলে তুলে বলল, বলি কোনওদিন শুনেছ ছেলের বিয়েতে বাপের নেমন্তন্ন হয়? তাহলে নিজের বিয়েতেও নেমন্তন্ন না হলে যাওয়া আটকায়। খেয়ে নাও তো।
খেয়েছিল হরিদেব। ভাত, মাংস, চাটনি, দরবেশ মিশে গিয়ে খুব খারাপও লাগেনি।
দ্বিতীয় বারেরটায় অত ঘটা হয়নি। তবে কারবাইডের আলো জ্বেলে রিকশা সাজিয়ে বউ এনেছিল। সেবারে ছিল ঘুগনি, কচুরি আর একটা করে শোনপাপড়ি।
এবারে কী হবে রে? খাওয়াবে তো বিয়েতে?
ধুস! নেত্য পথের ধারে একটা টিভির দোকানের সামনে ফস করে দাঁড়া হয়ে বলে, নারায়ণের ভোগ লাগিয়েছে। তারই প্রসাদ পাবে সবাই! বাতাসা, নাড়ু, আমের টুকরো, শিন্নি আর মিলক পাউডারের পায়েস। এক আঁজলায় খাওয়া হয়ে যায়। বাবা, ওই যে সমীরণবাবু যাচ্ছে। তোমাকে দেখেছে কিন্তু।
হরিদেব দেখে সমীরণবাবুই বটে। ঠান্ডা, সুস্থির লোক। গদাধরবাবুদের নীচের তলায় ভাড়া থাকে। স্টোভ জ্বেলে নিজে রান্না করে খায়।
নিত্য বলে, কেরোসিনের পয়সা কী করলে? মেরে দিয়েছ?
কিছু মনে পড়ে না। হরিদেব বলে, কোন পয়সা?
পণ্ডিতের দোকান থেকে কেরোসিন আনতে গেলে যে? সমীরণবাবু পাঁচ লিটারের দাম দিল না সেদিন? কাল আমাকে বলছিল, তোর বাবা আমার টাকাও মারল, তেলের টিনটাও গেল।
ওঃ! সে টিন টাকা সব পণ্ডিতের দোকানেই পড়ে আছে। ভুলে গিয়েছিলাম।
সে জানি! পণ্ডিত বলল, তুমি ত্রিশ পয়সা কম দিয়েছ পাঁচ লিটারের দামের চেয়ে।
মারিনি। খরচ হয়ে গেছে বোধহয়।
দেবে এখন সমীরণবাবু। ওই আসছে।
নিত্যপদ দোকানের টিভি সেট-এর দিকে চেয়ে থাকে।
সমীরণ সোজা এসে হরিদেবকে বলে, তেলটা এনে দিলে না যে বড়? কোথায় থাকো, খুঁজে পাই না।
খুব মোলায়েম হেসে হরিদেব বলে, আজ আমার ছেলের বিয়ে কিনা বাবু!-বলে বেশ একটা দেমাক বোধ করে।
ভ্রু কুঁচকে সমীরণ বলে, কাল সকালে এনে দিয়ো তবে। স্টোভে যা তেল আছে তাতে আজ হয়ে যাবে। কাল কিন্তু চাই।
দেব।
সমীরণ চলে যেতেই নিত্য বলে, আর একটু হলে টাকাটা ঠিক মেরে দিতে তুমি।
হরিদেব অবাক হয়ে বলে, মেরে দিলেই হল! মেরে তখন যাব কোথায়? ধরবে না?
শিউলির মা যে গম বেচতে দিয়েছিল তা সে বিক্রির পয়সা দিয়েছ ফেরত? আমাকে দেখলেই শিউলির মা বলে, তোর চোর বাপটা কই রে?