- বইয়ের নামঃ সাধুবাবার লাঠি
- লেখকের নামঃ শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
- প্রকাশনাঃ আনন্দ পাবলিশার্স (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ অদ্ভুতুড়ে সিরিজ
১. আদায় উসুল সেরে
সাধুবাবার লাঠি – অদ্ভুতুড়ে সিরিজ – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
আদায় উসুল সেরে গেজেতে টাকা ভরে কোমরে ভাল করে পেঁচিয়ে বেঁধে যখন নবীন গাঁয়ে ফেরার জন্য রওনা হল, তখন খেয়াল হল, শীতের বেলা ফুরিয়ে এসেছে। সন্ধে হয় হয়। বড্ড দেরি করে ফেলেছে সে। হরিপুর অনেকটা রাস্তা। প্রায় মাইলতিনেক। তার মধ্যে আড়াই মাইল হল গে জনমানবহীন ভুরফুনের মাঠ। ও মাঠে কোথাও বসতি নেই। মাঝে মাঝে জংলা জায়গা, জলা, একটা ভাঙা কেল্লা আর কিছু উদোম নিস্ফলা মাঠ। তার ভিতর দিয়েই এবড়োখেবড়ো মেঠো রাস্তা নানা বাঁক নিয়ে হরিপুর ঘেঁষে নয়াগঞ্জ অবধি চলে গেছে। সাইকেলখানা থাকলেও হত। কিন্তু সেখানা এই কাল রাতেই চুরি হয়ে গেছে ভিতরের বারান্দা থেকে। কাজেই হেঁটে আসতে হয়েছে নবীনকে। হেঁটেই ফিরতে হবে। সঙ্গীসাথী থাকলেও হত। কিন্তু কপাল খারাপ। আজ সঙ্গীসাথীও কেউ নেই। ভুরফুনের মাঠের বদনাম আছে। একসময়ে ঠ্যাঙাড়ে, ঠগিদের অত্যাচার ছিল খুব। এখন সে আমল নেই বটে, কিন্তু খারাপ লোকের তো আর আকাল পড়েনি। তা ছাড়া অন্য সব কথাও শোনা যায়। পারতপক্ষে রাতবিরেতে ও পথে কেউ পা বাড়ায় না।
কিন্তু ভয়ের কথা ভাবলেই ভয় আরও বেশি করে চেপে ধরে। ফিরতে যখন হবেই তখন ঠাকুরের নাম নিয়ে বুক ঠুকে রওনা হওয়াই ভাল।
হরিবোলজ্যাঠা মস্ত মহাজন। তার আড়তেই নবীনদের ধান, চাল, গম, আলুর চালান বেশি। অন্য সব মহাজনও আছে। সব মিলিয়ে
আদায় আজ বড় কম হয়নি। হরিবোলজ্যাঠা হাফ চশমার উপর দিয়ে তলচক্ষুতে চেয়ে বলল, “ওরে নবীন, সন্ধে করে ফেললি বাপ, অতগুলো টাকা নিয়ে রাতবিরেতে যাবি! বরং আজ গদিতেই থেকে যা। ভোর-ভোর রওনা হয়ে পড়বি।”
নবীনের সে উপায় নেই। আজ হরিপুরে মস্ত যাত্রার আসর। ব্যবস্থাপকদের মধ্যে নবীনও আছে। মাথা নেড়ে বলল, “তাড়া আছে জ্যাঠা। নইলে থেকেই যেতাম।”
“তা হলে বরং একটা লাঠিসোটা কিছু সঙ্গে রাখ। বদ বজ্জাতরা হাতে লাঠি দেখলে তফাত যাবে।”
“লাঠিকে আজকাল কেউ ভয় পায় না জ্যাঠা। বিপদে পড়লে বরং দৌড় লাগানো ভাল।”
“দুর বোকা, লাঠিই মানুষের চিরকেলে অস্তর। অন্তত শেয়াল কুকুর তাড়া করলে তো কাজে দেবে। সঙ্গে থাকলে একটা বলভরসা হয়। দাঁড়া, দেখি আমার কাছে কিছু আছে কিনা।”
হরিবোলজ্যাঠার গদির তক্তপোশের তলা থেকে গোটাকয়েক ধুলোমলিন লাঠি টেনে বের করল গদির কর্মচারী জগা। ন্যাকড়া দিয়ে মুছেটুছে হরিবোলজ্যাঠার সামনে রাখল। জ্যাঠা ভাল করে নিরখ পরখ করার পর একখানা লম্বা পাকা বাঁশের লাঠি তুলে নিয়ে বলল, “তুই এইটে নিয়ে যা। কয়েক বছর আগে হিমালয় থেকে এক সাধু এসে দিয়ে গিয়েছিল। পায়ে ঘা হয়ে দিনকতক আমার চণ্ডীমণ্ডপে ছিল বেচারি। রামকবিরাজকে দিয়ে চিকিৎসা করিয়ে ঘা সারিয়ে দিয়েছিলাম। সাধু যাওয়ার সময় লাঠিগাছ দিয়ে গিয়েছিল। আমার তো কোনও কাজে লাগে না। তুই-ই নিয়ে যা। তোকে দিলাম।”
নবীন দেখল, লাঠিটা তার মাথার সমান লম্বা। আর খুব ভারী। লাঠির দুই প্রান্ত লোহায় বাঁধানো। নিরেট, মজবুত লাঠি। হাতে নিলে একটা ভরসা হয়। আরও একটা ভরসার কথা হল, আজ শুক্লপক্ষের ত্রয়োদশী। সুতরাং সন্ধের পর জ্যোৎস্না ফুটবে।
হরিবোলজ্যাঠার আড়ত থেকে বেরিয়ে ভেলুর দোকানে গিয়ে ঢুকল নবীন। এ-দোকানের বিখ্যাত শিঙাড়া আর জিলিপি না খেলে জীবনই বৃথা। ফুলকপি, আলু, কিশমিশ আর বাদাম দিয়ে শিঙাড়াটা যা বানায় ভেলু, তেমনটি এ-তল্লাটে আর কেউ পারে না। জিলিপিটাও সাড়ে সাত প্যাঁচের মধুচক্র। দেরি যখন হয়েই গেছে তখন আর পনেরো মিনিটে কী-ই বা ক্ষতি! খিদেপেটে তিন মাইল হাঁটাও সম্ভব নয়।
ভেলুর দোকানে যেন রাসমেলার ভিড়, গঞ্জে যত ব্যাপারী মাল গন্ত করতে আসে সবাই হামলে পড়ে এই দোকানটাতেই। কাজেই নবীনকে নানা কসরত করে শিঙাড়া, জিলিপি জোগাড় করতে হল। তাতেও গেল মিনিট দশেক। এক কোণে বসে মন দিয়ে খাচ্ছিল সে। উলটো দিকে বসা রোগা সুডুঙ্গে চেহারার খোঁচা-খোঁচা দাড়িওয়ালা একটা লোক বলল, “ভাই, তুমি লেঠেল নাকি?”
নবীন একটু অবাক হয়ে চাইল। তারপর নিজের হাতে ধরা লাঠিটা খেয়াল হল তার। বলল, “তা বলতে পারেন।”
“প্যাঁচপয়জার জানা আছে তা হলে?”
“তা একটু-আধটু জানি বই কী!”কথাটা অবশ্য ডাহা মিথ্যে। নবীন কস্মিনকালেও লাঠি খেলতে জানে না। তবে লাঠিটা হাতে থাকায় তার বেশ একটা বলভরসা হচ্ছে।
ঢ্যাঙা লোকটা একটা কচুরিতে কামড় দিয়ে বলল, “সনাতন ওস্তাদের নাম শুনেছ?”
নবীন নির্বিকার মুখে বলল, “আজ্ঞে না।”
“সেকী হে! লাঠিবাজি করো আর ওস্তাদ সনাতনের নাম জানো?”
“তিনি কে বটেন?”
আলুর ঝোল সাপটানো কচুরিটা মুখে পুরে কাঁধের গামছায় হাত পুঁছে তাড়াতাড়ি জোড়হাত কপালে ঠেকিয়ে লোকটা বলল, “নমস্য ব্যক্তি হে, নমস্য ব্যক্তি। আমিও কিছুদিন তাঁর শাগরেদি করেছিলুম। তা পেটের ধান্দায় বেরিয়ে পড়তে হল বলে বিদ্যেটা শেখাই হল না। বলি পটাশপুরের নাম জানা আছে?”
শিঙাড়া চিবোতে-চিবোতে আরামে নিমীলিত চোখে চেয়ে নবীন বলল, “আজ্ঞে না।”