- বইয়ের নামঃ রাঘববাবুর বাড়ি
- লেখকের নামঃ শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
- প্রকাশনাঃ আনন্দ পাবলিশার্স (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ অদ্ভুতুড়ে সিরিজ
১. পুরুতমশাই নন্দলাল ভটচার্য
সকালবেলায় পুরুতমশাই নন্দলাল ভটচার্য রাঘব চৌধুরীর বাড়ির নিত্যপূজা সেরে বেরোচ্ছেন। হঠাৎ নজরে পড়ল বাইরের দিককার বাগানে একটা মুশকো চেহারার লোক উবু হয়ে বসে বাগানের কাঁটাতারের বেড়া মেরামত করছে। মুখটা ভারী চেনা-চেনা ঠেকল। এ গাঁয়ের লোক নয়, তবে কোথাও একে দেখেছেন।
নন্দলালের টিকিতে একটা কলকে ফুল বাঁধা, গায়ে নামাবলী, বাঁ বগলে ছাতা, ডান হাতে সিধের পুঁটুলি, পরনে হেঁটো ধুতি, পায়ে খড়ম। দেখলেই মানুষের ভক্তিশ্রদ্ধা হওয়ার কথা। হয়ও। নন্দলালকে দেখলেই লোকে একটু তটস্থ হয়ে পড়ে।
নন্দলাল দু পা এগিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “ওহে বাপু, মুখোনা বড্ড চেনা-চেনা ঠেকছে যে!”
অন্য কেউ হলে তাড়াতাড়ি উঠে হাতজোড় করে বলত, “পেন্নাম হই ঠাকুরমশাই” কিংবা, “পাতঃ পেন্নাম বাবাঠাকুর”, বা যা হোক ওরকম কিছু। এ লোকটা সেই ধার দিয়েই গেল না। দু’খানা জ্বলজ্বলে চোখে একবার তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিক্ষেপ করে বলল, ‘চেনা-চেনা ঠেকলেই যে চিনতে হবে তেমন কোনও কথা আছে?
লোকটা যে ঠ্যাটা এবং তিরিক্ষে, তা বুঝে নন্দলাল একটু দমে গেলেন। চেহারাখানা দেখে ষণ্ডাগুণ্ডা বলেই মনে হয়। ডাকাত বা খুন খারাপির আসামি হওয়াও বিচিত্র নয়। কথা হল, রাঘব চৌধুরীর বাড়িতে এসে জুটলই বা কী করে! আর এক কথা, লোকটাকে তিনি কোথাও দেখেছেন, কিন্তু কোথায় তা মনে পড়ছে না।
রাঘব চৌধুরী বড়লোক হলে কী হয়, ভারী খামখেয়ালি মানুষ। পাট আর গুণচটের পৈতৃক কারবারে লাখো-লাখো টাকা কামান বটে, কিন্তু লোকটার বাস্তববুদ্ধির একটু অভাব আছে। নইলে এ বাড়িতে যেসব লোক এসে জোটে, দূরদর্শী হলে কদাচ তাদের আশ্রয় দিতেন না।
পালোয়ান হাবু দাসের কথাই ধরা যাক। একসময়ে নাকি কুস্তি টুস্তি করত। রাঘববাবুর কাছে একদিন এসে ধরে পড়ল, “হুঁজুর, গতরখানা তো দেখেছেন। এই দেহের খোরাকটা একটু বেশিই। কিন্তু দিনকাল যা পড়েছে তাতে দু’বেলা ভরপেট জোটানোই মুশকিল, যদি একটু আশ্রয় দেন তা হলে যা করতে বলবেন, করব।”
রাঘববাবু বললেন, “আহা, কুস্তিগির তো একজন আমিও খুঁজছি, তা ভালই হল। আমার ছেলেপুলেগুলোকে শেখাও, আমিও মাঝেমধ্যে একটু-আধটু তালিম নেব’খন।”
তা হাবু দাস থেকে গেল। তার জন্য একটা আখড়াও তৈরি করে দিলেন রাঘববাবু। তাঁর দুই ছেলে প্রথম প্রথম উৎসাহের চোটে কুস্তি শিখতে লেগে পড়ল। কিন্তু দিনদুয়েক বাদেই গায়ের ব্যথায় দুইজনকে শয্যা নিতে হল। রাঘববাবুর গিন্নি বললেন, “ওদের হল নরম শরীর, দুধননী খেয়ে মানুষ, ওদের কি ওসব আসুরিক কাণ্ড সহ্য হয়! কবে কোনটার ঘাড় মটকে যায়, হাত বা পা ভাঙে, দরকার নেই বাবা কুস্তি শিখে। বাছারা আমার ননীর পুতুল হয়েই থাকুক।”
তা তাই হল। রাঘববাবুও একদিন কি দু’দিন ল্যাঙট এঁটে নেমেছিলেন বটে, কিন্তু বিশেষ সুবিধে করতে পারেননি। কয়েকদিন বাদেই হাবুর আখড়া ফাঁকা হয়ে গেল। তা হাবু তখন একা-একাই মুগুর ভাঁজত, ডন বৈঠক করত। কিন্তু কিছুদিন পরে তারও উৎসাহে ভাঁটা পড়ে গেল। এখন হাবু দাসের মাত্র দুটো কর্ম, খাওয়া আর ঘুমনো। অ্যাই বিরাট চেহারা হয়েছে, মস্ত ভূঁড়ি, শরীরে চর্বি থলথল করছে। দিনরাত ঘুমোলে আর রাশি রাশি খেলে যা হয়। কুস্তি দূরস্থান, এখন দশ পা হাঁটতেও তার হাঁফ ধরে।
ওই যে কালোয়াত গুণেন সাঁতরা, মস্ত নাকি গাইয়ে, কিন্তু গাঁ-গঞ্জে সমঝদার না পেয়ে একদিন সভাগায়ক হবে বলে রাঘববাবুর কাছে এসে হাজির।
রাঘববাবু সব শুনে তটস্থ হয়ে বললেন, “আজ্ঞে, আমি তো রাজা জমিদার নই, আমার সভা-টভাও নেই, কাজেই সভাগায়ক রাখার কথাই ওঠে না। আমি নিকষ্যি ব্যবসাদার।”
গুণেন ভারী মুষড়ে পড়ে বলল, “তবে যে সবাই বলছিল আপনার কাছে এলেই নাকি একটা হিল্লে হবে?”
রাঘববাবু কাঁচুমাচু হয়ে বললেন, “আজ্ঞে, কালোয়াতি গানও আমি বুঝি না। বড়জোর কেত্তন বা শ্যামাসঙ্গীত অবধি আমার দৌড়, তবে গুণী মানুষের কদর আমি বুঝি। এসে যখন পড়েছেন তখন তো আর ফেলতে পারি না।”
তা গুণেনও থেকে গেল। প্রথম প্রথম ভোররাতে উঠে খুব রেওয়াজ-টেওয়াজ করত। সেই আওয়াজে গঞ্জের যত কুকুর এসে রাঘববাবুর সদরে জুটে সে কী ঘেউ-ঘেউ! তার মানে এ নয় যে গুণেন কিছু খারাপ গাইত, কিন্তু এলাকায় কুকুরগুলোেই বজ্জাত বেরসিক। বিরক্ত হয়ে গুণেন রেওয়াজ প্রায় ছেড়েই দিল। এখন তাস-পাশা খেলে সময় কাটায়। মাঝে-মাঝে একটু-আধটু গুনগুন করে।
ওই যে লম্বা, সুড়ঙ্গে, সুটকো চেহারার ভূতনাথ হালদার, সে নাকি একজন ভূত-বিশারদ। যত বুজরুক সব এসে এই রাঘবের ঘাড়ে ভর করে। ভূতনাথ নাকি ভূতবিদ্যা গুলে খেয়েছে। তার চারদিকে সর্বদাই ভূতের ভিড়! বছরটাক আগে এসে সেও জুটে গেল এ বাড়িতে। রাঘবকে বলল, “বাবুমশাই, ভূত বড় ত্যাঁদড় জিনিস, এমনিতে টেরটি পাবেন না। কিন্তু ধরুন চিতল মাছের পেটি দিয়ে পরিপাটি ভাত খাবেন বলে মনস্থ করলেন, একটা দুষ্টু ভূত এক খাবলা নুন দিয়ে গেল ঝোলে।”
রাঘব সায় দিয়ে বললেন, “হ্যাঁ হ্যাঁ, এরকম তো হয়ই।”