- বইয়ের নামঃ ময়নাগড়ের বৃত্তান্ত
- লেখকের নামঃ শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
- প্রকাশনাঃ পত্র ভারতী (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ অদ্ভুতুড়ে সিরিজ
১. পৌষ মাসের এই সকালবেলায়
ময়নাগড়ের বৃত্তান্ত – অদ্ভুতুড়ে সিরিজ – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
বৃত্তান্ত কথা
ময়নাগড়ের বৃত্তান্ত ভিন্ন নামে আনন্দমেলায় ধারাবাহিক প্রকাশিত হয়েছিল বেশ কয়েক বছর আগে। নানা কারণে উপন্যাসটি আমি প্রকাশ করতে অনুমতি দিইনি কাউকেই। মনে হয়েছিল, বেশ কিছু পরিবর্তন করা দরকার। এখন দেখছি, সংস্কার করতে হলে পুরো উপন্যাসটিই নতুন করে লিখতে হয়। আর তাই যদি হয় তাহলে পুরোনো উপন্যাসটি তার মূল রূপে প্রকাশ পেলে ক্ষতি কিছু নেই। ময়নাগড়ের বৃত্তান্ত তাই দু-হাজার এগারোর কলকাতা বইমেলায় প্রকাশিত হল। এর জটিল কাহিনি ও বিস্তার কার কেমন লাগবে, কে জানে!
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
৩০ ডিসেম্বর ২০১০
.
পৌষ মাসের এই সকালবেলায় ময়নাগড়ে অখণ্ড ৫। শান্তি বিরাজ করছে। রোদ এখনও ভালো করে ওঠেনি, চারদিকে বেশ জম্পেশ কুয়াশাও জমে আছে। রাঙা রোদ অবশ্য কুয়াশাকে হুড়ো দিয়ে তাড়ানোর প্রাণপণ চেষ্টা করছে। তাই একটু-একটু রাঙা আলো ফুটে উঠছে চারধারে। আর সেই আলোয় দেখা যাচ্ছে পশুপতিবাবু তার বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁতন করছেন। এই দাঁতন করার সময়টায় তার মুখে একটা স্বর্গীয় আনন্দ ফুটে ওঠে। তিনি লোককে প্রায়ই বলেন, দাঁতন করার সময় আমার ভারী একটা দিব্যভাব আসে। মনে হয় যেন বাতাসের উপর হাঁটছি, অনেক অলৌকিক দৃশ্য দেখতে পাচ্ছি, অনেক অলৌকিক শব্দ শুনতে পাচ্ছি।
একটু পশ্চিমধারে নিজেদের বাড়ির উঠোনে গদাধর এইমাত্র পাঁচশো ডন শেষ করে পাঁচশো বৈঠক দিতে শুরু করেছে। তার হুপহাপ শব্দে বাতাস কাঁপছে। গদাধরও বলে, ডন-বৈঠক-মুগুর ভাজার সময় সে নাকি আর গদাধর থাকে না। তার শরীরে নাকি অন্য কিছু একটার ভর হয়। বাহ্য চৈতন্য থাকে না বলেই বোধহয় মাসখানেক আগে এক ভোরবেলায় চোর এসে তার সাইকেলখানা চোখের উপর দিয়েই চুরি করে নিয়ে গেল। গদাধর দেখেও দেখতে পায়নি।
থানার সেপাই রামশরণ হনুমানজির মন্দিরে পুজো চড়িয়ে ভজন গাইছে। মন্দিরটা অবশ্য একেবারেই বেঁটে বক্কেশর। মাত্র হাততিনেক উঁচু, বড়জোর দু-হাত লম্বা আর আড়াই হাত চওড়া। ভিতরে অঙ্গুষ্ঠপ্রমাণ একটা মূর্তিও আছে। তবে তেল-সিঁদুর, শ্যাওলা আর ময়লায় মূর্তির মুখ চোখ কিছু বোঝবার উপায় নেই। কিন্তু রামশরণ রোজ সকালে বিভোর হয়ে বেসুরো গলায় ভজন গেয়ে তার ভক্তি নিবেদন করে। হনুমানজির উপর তার ভক্তির কারণ আছে। সময়টা রামশরণের খারাপ যাচ্ছে। তার মোষটাকে নিধুবাবু খোঁয়াড়ে দিয়েছেন, তার ছেলে শিউশরণ এবার নিয়ে তিনবার ক্লাস সিক্সে ফেল মেরেছে। হেড কনস্টেবল হরিপদ সামনের মাসে রিটায়ার হওয়ার পর ওই পোস্টে রামশরণের যাওয়ার কথা, কিন্তু শোনা যাচ্ছে, ষষ্ঠীচরণকেই নাকি ওই পোস্টে বড়বাবু রেকমেন্ড করেছেন।
জীবনের উপর ঘেন্না ধরে যাওয়ায় পাঁচু কয়েকবারই অন্য মানুষ হয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে। তাতে যে একটুআধটু কাজ হয়নি তাও নয়। পুরোনো পাঁচু কিছুতেই তার পাছু ছাড়ে না। সে হয়তো একদিন সকালে ঠিক করল, আজ থেকে সে নন্দগোপাল হয়ে যাবে। ব্যস, সেদিন সকাল থেকেই সে প্রাণপণে নন্দগোপাল হতে চেষ্টা করতে লাগল।
তবে নন্দগোপাল হওয়া খুব সোজা কাজ তো নয়। নন্দগোপাল হচ্ছে ভারী বিনয়ী লোক। এত বিনয়ী যে, যার সঙ্গেই দেখা হয় তাকেই হাত কচলে, গ্যালগ্যালে হেসে বিনয়বচন আওড়াতে থাকে, আমি আপনার পায়ের ধুলোরও যুগ্যি নই, আপনার গোয়ালের গোরুটার চেয়েও আমাকে তুচ্ছ জ্ঞান করবেন, আপনার বাড়ির পাপোষটার মর্যাদাও আমার চেয়ে বেশি, বড় হতভাগা আমি, বড়ই অকিঞ্চন, মাঝে-মাঝে আমাকে জুতোপেটা করবেন তো ভাই!
তা পাঁচুও ওইসব বলে বেড়াতে লাগল। একদিন নরহরি ঘোষ তার বিনয়বচন খুব মন দিয়ে শুনে বলল, হ্যাঁ রে পাঁচু, নন্দগোপাল কি মারা গেছে? কই, মারা গিয়ে থাকলে তার শ্রাদ্ধের নেমন্তন্ন পেলুম না তো!
জিভ কেটে পাঁচু বলে, না না, ছিঃ ছিঃ, তিনি মরবেন কেন?
নরহরি তখন ভাবিত হয়ে বলে, না মরলে তার ভূত তোর ঘাড়ে ভর করল কি করে? বিজ্ঞান তো শিখলি না। বিজ্ঞানে পরিষ্কার বলা আছে, কেউ না মরলে ভূত হওয়ার জো নেই। জ্যান্ত মানুষের ভূত বলে বিজ্ঞান কিছু স্বীকারও করে না কিনা! অথচ দেখছি নন্দগোপালের ভূত দিব্যি তোর ঘাড়ে চেপে বসে ঠ্যাং দোলাচ্ছে।
পাঁচু মাথা চুলকে বলল, ভূত-প্রেতের ব্যাপার নয় আজ্ঞে। নন্দগোপালবাবু বড্ড ভালো লোক তো, তাই একটু সেরকম হওয়ার চেষ্টা করছিলাম আর কি।
রাম রাম। নন্দগোপাল হতে চায় আহাম্মকেরা। সবসময় গ্যালগ্যালে ভাব নিয়ে থাকলে কেউ পোঁছে না। দেখিস না, নন্দ রাস্তায় বেরোলে পাড়ার ছেলেরা ওর পিছনে লাগে, হাততালি দিয়ে ছড়া কেটে খ্যাপায়। যদি মানুষের মতো মানুষ হতে চাস, তবে আমার মতো হ। লোকে আমাকে বিশ্বনিন্দুক বলে বটে, আসলে আমি মানুষের দোষ মোটে সইতে পারি না। লোকে আমাকে তো ঝগড়ুটেও বলে, আসলে কি আমি তাই? তবে হ্যাঁ, আমি উচিত কথা বলতেও কাউকে ছাড়ি না। লোকে আমাকে হিংসে করে কিপটেও তো বলে! তাই বলে কি আমি কিপটে হয়ে গেছি নাকি? এই তো আজ সকালেই ফুটকড়াই দিয়ে জলখাবার খেয়েছি। মিতব্যায়ী আর কৃপণ কি এক হল? সবদিক বিচার করে দেখেছি রে বাপু, আমার মতো লোক হয় না।