- বইয়ের নামঃ বিপিনবাবুর বিপদ
- লেখকের নামঃ শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
- প্রকাশনাঃ আনন্দ পাবলিশার্স (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ অদ্ভুতুড়ে সিরিজ
১. নিজের দুঃখের কথা ভাবলে
নিজের দুঃখের কথা ভাবলে বিপিনবাবু বেশ আনন্দ পান। যখনই ভাবেন, আহা আমার মতো এমন দুঃখী আর কে আছে, তখনই তাঁর চোখ ভরে জল আসে এবং মনটা ভারী হালকা হয়ে যায়। আর সেজন্যই বিপিনবাবু নিয়ম করে দু’বেলা ঘরের দরজা-জানলা এঁটে বসে নিজের দুঃখের কথা ভাবেন। ওই সময় বাড়ির লোক তাঁকে ভুলেও ডাকে না বা বিরক্ত করে না।
মাঘ মাস। নফরগঞ্জে হাড় কাঁপানো শীত পড়েছে। সন্ধের পর আর রাস্তাঘাটে মানুষ দেখা যায় না। কুকুর-বেড়ালটা পর্যন্ত পথে বেরোয় না। বিপিনবাবু নিজের ঘরে বসে একখানা ভারী বালাপোশে সর্বাঙ্গ ঢেকে খুবই আনন্দের সঙ্গে নিজের দুঃখের। ভাবতে শুরু করেছেন। ভাবতে-ভাবতে চোখে জল আসি-আসি করছে। মনটা বেশ হালকা হয়ে যাচ্ছে।
এই সময়ে বাইরে থেকে খনখনে গলায় কে যেন ডাকল, “বিপিনবাবু, আছেন নাকি? ও বিপিনবাবু..”
বিপিনবাবু ভারী বিরক্ত হলেন। এই শীতের সন্ধেবেলা আবার কে এল? গলাটা তো চেনা ঠেকছে না! দুঃখের কথা ভাবার বারোটা বেজে গেল। বিপিনবাবু হ্যারিকেনটা হাতে নিয়ে উঠে
দরজা খুলে বাইরে অন্ধকারে মুখ বাড়িয়ে বললেন, “কে? কে ডাকছে?”
“আজ্ঞে, এই যে আমি!” বলে অন্ধকার থেকে একটা লোক এগিয়ে এসে বারান্দায় উঠল।
হ্যারিকেনের আলোয় যেটুকু দেখা গেল তাতে মনে হল, লোকটি খুবই বুড়োমানুষ এবং বড় রোগা। মাথায় বাঁদুরে টুপি, গায়ে একটা লম্বা ঝুলের কোট, হাতে একখানা লাঠি।
বিপিনবাবু বিরক্ত হয়ে বললেন, “কোথা থেকে আগমন হচ্ছে?”
খনখনে গলায় লোকটি বলল, “বলছি মশায়, বলছি। কিন্তু শীতে যে হাত-পা সব কাঠ হয়ে গেল। একটু ঘরে ঢুকতে দেবেন
দিনকাল ভাল নয়। উটকো লোককে ঢুকিয়ে শেষে বিপদ ঘটাবেন নাকি? রোগা বা বুড়ো হলে কী হয়, হাতে লাঠি তো আছে। তা ছাড়া বাইরের লোককে ঘরে ঢোকাতে অন্যরকম আপত্তিও আছে বিপিনবাবুর। তিনি বিখ্যাত কৃপণ। তাঁর বাড়ির পিঁপড়েরাও খেতে না পেয়ে চিচি করে। এমনকী, এ-বাড়িতে কুকুর-বেড়াল নেই, কাকপক্ষীরাও বড় একটা আসে না। বাইরের লোক এলে পাছে লৌকিকতা করতে হয়, সেই ভয়ে বিপিনবাবু। বাইরে থেকেই সাক্ষাৎপ্রার্থীকে বিদেয় করে দেন। লোকে বিপিনবাবুকে চেনে, তাই আসেও না বড় একটা। বিপিনবাবু তাই দরজা আটকে দাঁড়িয়ে বললেন, “আমি ব্যস্ত আছি। সংক্ষেপে যা বলার বলুন।”
বিপিনবাবুর ঘোরতর সন্দেহ হল, লোকটা মেয়ের বিয়ের জন্য সাহায্য বা ছেলের বই কেনার টাকা না হয় ওরকমই কিছু চাইতে এসেছে।
লোকটা কিন্তু বড় সোজা লোক নয়। দরজা জুড়ে দাঁড়ানো বিপিনবাবুকে একটা গুতো মেরে সরিয়ে ঘরে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে বলল, “ওরে বাবা, এই শীতে কুকুর-বেড়ালটা পর্যন্ত পথে বেরোয়নি, আর আপনি এই বুড়োমানুষটাকে ঘরে ঢুকতে দিচ্ছিলেন না, অ্যাাঁ! লোকে যে আপনাকে পাষণ্ড বলে তা তো এমনি বলে না মশায়!”
লোকটা বুড়ো হলেও হাতে-পায়ে দিব্যি জোর। কনুইয়ের অঁতো বিপিনবাবুর পাঁজরে এমন লেগেছে যে, তিনি ককিয়ে উঠে বুক চেপে ধরলেন। তারপর খেঁকিয়ে উঠে বললেন, “কে আমাকে পাষণ্ড বলে শুনি?”
“এখনও বলেনি কেউ? সে কী কথা! নফরগঞ্জের লোকেরা কি ভাল-ভাল কথা ভুলে গেল?”
বিপিনবাবু খুবই রেগে গিয়ে বললেন, “পাষণ্ড বললে তো আপনাকেই বলতে হয়। কনুই দিয়ে ওরকম তো যে দেয় সে অত্যন্ত হৃদয়হীন লোক। বুড়োমানুষ বলে কিছু বলছি না, তবে–”
লোকটা একটা কাঠের চেয়ারে জুত করে বসে হাতের লাঠিটা চেয়ারের গায়ে ঠেস দিয়ে দাঁড় করিয়ে রেখে বলল, “কী বললে, হৃদয়হীন? বাঃ, একথাটাও মন্দ নয়। তবে তোটা না দিলে তুমি তো আর আমাকে ঢুকতে দিতে না হে বাপু! তুমি আমাকে না চিনলেও আমি তোমাকে খুব চিনি। তুমি হলে হাড়কেল্পন বিপিনবিহারী রায়। তোমার বাড়িতে ভিখিরি কাঙাল আসে না। খরচের ভয়ে তুমি বিয়ে করে সংসারী অবধি হওনি।”
বিপিনবাবু এসব কথা বিস্তর শুনেছেন, তাই ঘাবড়ালেন না। বরং খাপ্পা হয়ে বললেন, “বেশ করেছি হাড়কেপ্পন হয়েছি। কেন হয়েছি তো নিজের পয়সায় হয়েছি। আপনার তাতে কী?”
লোকটা মৃদু-মৃদু মাথা নেড়ে বেশ মোলায়েম গলাতেই বলল, “তা অবশ্য ঠিক। তুমি কৃপণ তো তাতে আমার কী যায়-আসে। তবে বাপু, সত্যি কথা যদি শুনতে চাও আমি একজন পাকা কেন লোকই খুঁজে বেড়াচ্ছি। কাউকে তেমন পছন্দ হচ্ছে না। এই তুমি হলে তেরো নম্বর লোক।”
বিপিনবাবু দাঁত কড়মড় করে বললেন, “বটে! তা কেন দিয়ে কী করবেন শুনি! কেল্পনদের ফলারের নেমন্তন্ন করবেন নাকি?”
“ওরে সর্বনাশ! না না হে বাপু, ওসব নয়। একজন পাকাঁপোক্ত কেপ্লন আমার খুবই দরকার। কারণটা গুরুতর।“
বিপিনবাবু একটু বুক চিতিয়েই বললেন, “শুনুন মশাই, কৃপণ খুঁজতে আপনি খুব ভুল জায়গায় এসে পড়েছেন। আমি কস্মিনকালেও কৃপণ নই। একটু হিসেবি হতে পারি, কিন্তু কৃপণ কেউ বলতে পারবে না আমাকে। আমি রোজ সকালে মর্তমান কলা খাই, বাজার থেকে ভাল-ভাল জিনিস কিনে আনি, বছরে একজোড়া করে জুতো কিনি, আমার তিনটে ধুতি আর তিনটে জামা, দুটো গেঞ্জি আর একখানা আলোয়ান আছে। কৃপণ হলে হত এত সব? এবার আপনি আসুন গিয়ে। আমার এখন অনেক কাজ।”