- বইয়ের নামঃ পটাশগড়ের জঙ্গলে
- লেখকের নামঃ শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
- প্রকাশনাঃ আনন্দ পাবলিশার্স (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ অদ্ভুতুড়ে সিরিজ
১. জয়পতাকাবাবুকে দেখে
পটাশগড়ের জঙ্গলে – অদ্ভুতুড়ে সিরিজ – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
জয়পতাকাবাবুকে দেখে কিন্তু মোটেই বীর বলে মনে হয় না। তিনি ভজুরাম মেমোরিয়াল স্কুলের নামকরা অঙ্কের মাস্টারমশাই। কোঁচানো ধুতি, ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি, চোখে গোল রোল্ডগোল্ড ফ্রেমের চশমা, মাথার মাঝখানে চেরা সিঁথি, পায়ে শীত গ্রীষ্ম বর্ষা সবসময়ে সাদা মোজা আর পাম্পশু। বয়স পঁচিশ-ছাব্বিশের বেশি নয়। কিন্তু গাম্ভীর্য, পোশাক আর চালচলনে প্রবীণের মতো দেখায়। ছেলেরা তাঁকে ভয় খায় বটে, কিন্তু বীর বলে মনে করে না।
সেবার ভজুরাম মেমোরিয়ালের সঙ্গে কালীতলা স্কুলের ফুটবল ম্যাচ। দুটোই নামা টিম। সুতরাং মর্যাদার লড়াই। মাঠে কাতারে কাতারে লোক জড়ো হয়েছে খেলা দেখতে। খেলা শুরু হয়-হয়। ঠিক এই সময়ে বিপত্তিটা ঘটল।
শহরের সবচেয়ে সাঙ্ঘাতিক জীবটির নাম হচ্ছে কালু। যে হল শিবের ষাঁড়। গায়ে-গতরে যেমন বিশাল, তেমনি তার গোঁ আর রাগ। খেপলে সে আরবি ঘোড়ার মতো দৌড়য়।
ঘোষবাড়ির ভুতু হচ্ছে এশহরের সবচেয়ে বিচ্ছু ছেলে। ভজুরাম মেমোরিয়ালের ক্লাস এইটের ছাত্র। ফুটবল টিমে তার ঢাকা অনিবার্য ছিল। কিন্তু হেডসারের ইংরেজি ক্লাসের সময় সে সারের টেবিলের নিচে একটা জ্যান্ত কাঁকড়া বিছে ছেড়ে দেওয়ার অপরাধে তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। খেলা তো বন্ধই, স্কুল থেকে তাড়িয়েও দেওয়া হতে পারে।
ভুতু খেলার দিন একটা পাকা কাঁঠাল জোগাড় করে সোজা বাজরের রাস্তায় কালুকে গিয়ে ধরল। কালু বটতলায় বসে ঝিমোচ্ছিল, কাঁঠালের মনমাতানো গন্ধে চনমন করে উঠল। ভুতু একটি একটি করে কাঁঠালের কোয়া নিজে হাতে কালুকে খাওয়াতে খাওয়াতে খেলার মাঠের দিকে হাঁটতে লাগল। কাঁঠালের সম্মোহনে কালুও তার পিছু পিছু যাচ্ছে।
খেলার মাঠে সাঙ্ঘাতিক ভিড়। চেঁচামেচিও বেশ হচ্ছে। কাঁঠাল খাওয়ানো শেষ করে ভুতু কালুর লেজ ধরে পেল্লায় এক মোচড় দিয়ে বলল, “যাঃ, কালু যাঃ, লেগে পড়। সব লণ্ডভণ্ড করে দে।”
কালু লেজের মোচড় পছন্দ করে না। সে ফোঁস করে একটা শ্বাস ছেড়ে বাঘের মতো গর্জন করল। আর তখন, কাঁঠালের ভুতিটা তাকে একবার শুকিয়ে ভুতু সেটা মাঠের মাঝখানে ছুঁড়ে দিয়েই পালাল।
তারপর আর কাণ্ডটা দেখতে হল না। কালু আর-একটা গর্জন ছেড়ে তীব্র গতিতে ভিড়ের মধ্যে গিয়ে পড়ল। গোটাচারেক লোক শূন্যে ডিগবাজি খেয়ে ছিটকে পড়ল। তারপর মাঠের মাঝখানে এক রণতাণ্ডব শুরু করে দিল কালু।
লোকে পড়ি কি মরি করে পালাতে লাগল চারিদিকে। প্লেয়াররা কিছু পালাল, কয়েকজন গোল পোস্টের ওপর উঠে পড়ল। চারদিকে হুড়োহুড়ি হুলুস্থুল কাণ্ড।
একধারে দুই স্কুলের মাস্টারমশাইরা চেয়ারে বসেছিলেন। মাঝখানে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, সামনের টেবিলের ওপর ষষ্ঠীচরণ। স্মৃতি শিল্ড এবং বগলাপতি রানার্স আপ কাপ সাজানো। কালু মাঠে নামতেই মাস্টারমশাইরা উঠে দুড়দাড় পালালেন। ম্যাজিস্ট্রেটসাহেব চেঁচিয়ে পুলিশদের ডাকাডাকি করছিলেন। কেউ অবশ্য এগিয়ে এল না। এখানকার পুলিশদের ধারণা, কালু শিবের সাক্ষাৎ বাহন, তার গায়ে গুলিও লাগবে না। উপরন্তু শিবের কোপে নির্বংশ হতে হবে।
ঠিক এই সময়ে দেখা গেল, জয়পতাকাবাবু বীরদর্পে উঠে দাঁড়িয়েছেন। একটা লাল সালুতে ‘ষষ্ঠীচরণ স্মৃতি শিল্ড’ লেখা। যেটা প্যান্ডেলের মাথায় টাঙানো ছিল। একটা চেয়ারে উঠে সালুটা খুলে ফেললেন জয়পতাকাবাবু। তারপর সোজা মাঠে নেমে কালুর মুখোমুখি হলেন।
কালু এমনিতেই রাগী। এত লোক দেখে তার মাথা আরও গরম হয়েছে। তার ওপর ভিড়ের মধ্যে সে কাঁঠালের ভুতিটাও খুঁজে পায়নি। তার চোখ লাল, মুখে ফেনা, গলা দিয়ে ঠিক বাঘা গর্জন বেরোচ্ছে। ঠিক এই সময়ে ধুতি-পাঞ্জাবি-পরা জয়পতাকাবাবুকে সে দেখতে পেল। একেবারে মুখোমুখি। এবং দেখল, তাঁর হাতে লাল সালু।
লাল দেখে আর মাথার ঠিক রাখতে পারল না কালু। সব ভুলে সে তেড়ে এল জয়পতাকাবাবুর দিকে।
কিন্তু অকুতোভয় জয়পতাকা স্যার স্পেনদেশীয় বুল-ফাইটারদের মতোই অনায়াস দক্ষতায় সালুটা একটু পাশ কাটিয়ে ধরলেন। কালু তেড়ে আসতেই চট করে সরিয়ে নিলেন। দিগভ্রান্ত কালু খানিকটা দৌড়ে গিয়ে ভুল বুঝতে পেরে ফিরল। এবং আবার মাথা নিচু করে শিং উচিয়ে তেড়ে এল।
ডাকাবুকো জয়পতাকাবাবু আবার কালুকে দিগভ্রান্ত করে দিলেন।
এই কাণ্ড দেখে পলাতক লোজনেরা আবার ফিরে আসতে লাগল। চারদিকে করতালি ও হর্ষধ্বনিও শোনা যেতে লাগল। এর ফলে জয়পতাকাবাবু খুবই উদ্দীপ্ত হয়ে উঠলেন। লোকে ফুটবল খেলা ছেড়ে তাঁর সঙ্গে ষাঁড়ের লড়াই দেখছে, এটা কম কথা নয়। তিনি দ্বিগুণ উৎসাহে কালুর সম্মুখীন হলেন এবং আবার কালুকে লাল সালু দিয়ে একেবারে বোকা বানিয়ে ছাড়লেন।
বারবার তিনবার, জয়পতাকাবাবু রীতিমত চনমনে হয়ে উঠেছেন। বেঁচে থাকার একটা আলাদা স্বাদ পাচ্ছেন। অঙ্ক কষাতে বা ছেলেদের পড়াতে তিনি দারুণ আনন্দ পান, কিন্তু এ-আনন্দ সেই আনন্দের চেয়েও যেন বেশি।