- বইয়ের নামঃ নবাবগঞ্জের আগন্তুক
- লেখকের নামঃ শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
- প্রকাশনাঃ আনন্দ পাবলিশার্স (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ অদ্ভুতুড়ে সিরিজ
১. ঘরে চোর ঢুকেছে
নবাবগঞ্জের আগন্তুক – অদ্ভুতুড়ে সিরিজ – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
ঘরে চোর ঢুকেছে টের পেয়ে মাঝরাতে গবাক্ষবাবু বিছানায় উঠে বসলেন। তারপর ঠাণ্ডা গলায় বললেন, “কে ঢুকেছিস রে ঘরে? যোগেন নাকি? নাকি পঞ্চানন! চারু নয় তো! হাবুল নাকি তুই?”
কিছুক্ষণ চুপচাপ। তারপর একটা মোলায়েম গলা বলল, “আমি প্রিয়ংবদ।”
“প্রিয়ং… কী বললি?”
“বদ।”
“বদ তো তুই বটেই। বদের হাঁড়ি। কিন্তু নামটা নতুন হলেও গলাটা যে পুরনো! চেনা-চেনা ঠেকছে। তা নাম পালটালি কী করে?”
“কাছারিতে গিয়ে পয়সা খরচ করে মশাই।”
গবাক্ষবাবু মুখে একটা দুঃখসূচক চুক চুক শব্দ করে বললেন, “পয়সাটা বৃথাই গেল রে। গাঁ-গঞ্জের মানুষ কি আর এত ভাল নামের কদর বুঝবে? উচ্চারণই করতে পারবে না।”
কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে মোলায়েম গলাটা বেশ ক্ষোভের সঙ্গেই বলল, “গাঁয়ের লোকের উশ্চাটনের কথা আর বলবেন না মশাই। উশ্চাটন একেবারে যাচ্ছেতাই। আগে পঞ্চা-পঞ্চা করত, এখন পেড়াপেড়ি করায় বন্দু বন্দু বলে ডাকে। প্রিয়ংবদ উশ্চাটনই করতে পারে না।”
“তাই বল, তুই তা হলে আমাদের পুরনো পঞ্চা চোর! তা আমার বাড়িতে কী মনে করে? আমার বাড়িতে কি তোষাখানা খুলে বসেছি? না কি টাঁকশাল বসিয়েছি?”
“তা জানি মশাই। আপনি হুঁশিয়ার লোক। এ-বাড়িতে চোরের একাদশী।”
গবাক্ষবাবু খিঁচিয়ে উঠে বললেন, “তা হলে ঢুকলি যে! কী মতলব তোর?”
“টাকাপয়সার ভরসায় আসিনি। একখানা জিনিস খুঁজতে এসেছি।”
“জিনিস! জিনিসটাই বা কী এমন রেখেছি যে চোর ঢুকবে! তোদের কি ধারণা ঘরে দামি-দামি জিনিস রেখে চোরদের নেমন্তন্নের চিঠি পাঠিয়ে বসে আছি। আমি তেমন বান্দা নই।”
পঞ্চা খুক করে একটু হেসে বলল, “তা আর বলতে! ঘরের যা ছিরি করে রেখেছেন তাতে ঢুকতে লজ্জাই হয়। তক্তাগপাশের তো একখানা পায়াই নেই, ইটের ঠেকনো দিয়ে রেখেছেন। রান্নাঘরে কয়েকখানা মেটে হাঁড়িকুড়ি আর কলাই করা থালাবাটি। না মশাই, চোরেরও মান-সম্মান আছে।”
পঞ্চার এই কথায় গবাক্ষবাবুর একটু প্রেস্টিজে লাগল। তিনি অতিশয় গম্ভীর গলায় বললেন, “তা হলে কি তুই বলতে চাস আমি ছ্যাঁচড়া লোক?”
“বললে ছোট মুখে বড় কথা হয়ে যাবে। তবে সত্যি কথা বলতে হলে বলতেই হবে যে ছ্যাঁচড়া শব্দটা যেন আপনার জন্যই জন্মেছে। অনেক বাড়িতে ঢুকেছি মশাই, কারও বাড়িতে এমন দুর্দশা দেখিনি। চোরদের জন্য কি আপনার একটু মায়াও হয় না?”
গবাক্ষবাবু বেশ অপমান বোধ করছেন, কিন্তু প্রতিবাদ করারও উপায় নেই। পঞ্চা সত্যি কথাই বলছে। তাই গবাক্ষবাবু গলাটা একটু নামিয়ে বললেন, “ভাল করে খুঁজলে কি আর টাকাটা সিকিটা পেতি না?”
“আজ্ঞে সেকথা ঠিক। খুঁজলে আপনার ঘরে টাকাটা সিকিটা কপালে যে জোটে না তা নয়। বাঁদিকে পায়ের কাছে তোশকের তলায় একখানা সিকি আছে, বালিশের তলায় একটা আধুলি, আলনায় যে ছেঁড়া জামাখানা ঝুলছে তার বাঁ পকেটে একখানা কাঁচা টাকাও আছে বটে, তবে সেটা অচল। আজ বাজারে আলুওলা টাকাটা নিতে চায়নি বলে আপনার খুব মেজাজ চড়ে ছিল।”
“টাকাটা মোটেই অচল নয়। চালালে দিব্যি চলে যাবে।”
“তা যাবে। সাঁঝবাজারে যে-লোকটা ঘানিঘরের পাশে বেগুন বেচতে বসে তার দু চোখে ছানি। তাকে গছাতে পারেন। নইলে ঈশেনপুরের নন্দী মহাজনের হাবাগোবা বাজার সরকার মহেশবাবুকে। নইলে জকপুর বুনিয়াদি বিদ্যালয়ের অঙ্কের মাস্টার পাগলা কালীবাবুকে। ভারী আনমনা লোক। অঙ্কের পণ্ডিত হলে কী হবে, বাজার করতে গিয়ে সাত টাকা কিলোর সাড়ে তিনশো গ্রাম জিনিসের দাম কষতে গলদঘর্ম হতে হয়।”
ফাঁপরে পড়ে গবাক্ষবাবু বললেন, “এত ফ্যাচফ্যাচ করিস নে তো। টাকাটা অচল হলে কি আমিই নিতুম! বেকুব তো আর নই।”
“নিলেন আবার কোথা, এটা তো পড়ে পাওয়া। কথায় কথায় কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে সাপ বেরিয়ে পড়বে মশাই। কালীর থানের সামনে যখন কাল বিকেলে আপনি টাকাটা কুড়িয়ে পেলেন তখন তো জগা বটতলায় বাঁধানো বেদিতে বসে পা দোলাচ্ছিল। স্বচক্ষে দেখেছে। টাকাটা পড়ে আছে সেটা জগাও জানত। কুড়িয়েছিল, তবে অচল দেখে ফের ফেলে রাখে।”
গবাক্ষবাবু ফের ফাঁপরে পড়ে বললেন, “একখানা টাকার তো মামলা। তা নিয়ে অত কচলাচ্ছিস কেন?না হয় অচলই হল টাকাটা, তাতে কোন মহাভারত অশুদ্ধ হল শুনি।”
“না, টাকাটা সিকিটার কথা বলছিলেন কিনা, তাই বলা। ওসব ছোটখাটো ব্যাপারের জন্য আসা নয় মশাই। অন্য কাজ আছে।”
“সেইটে বলে ফেললেই তো ল্যাটা চুকে যেত। চোরেদের আজকাল যা আস্পর্ধা হয়েছে তা আর কহতব্য নয়। চুরি করতে ঢুকেছিস, কোথায় মিনমিন করবি, ঘাড় হেঁট করে থাকবি, ধরা পড়ে চোখের জল ফেলবি, হাতে পায়ে ধরবি, তা নয় উলটে গলা তুলে ঝগড়া করছিস!”
“ঝগড়া! কস্মিনকালেও কারও সঙ্গে ঝগড়া করিনি মশাই, তবে হ্যাঁ, দরকার হলে উচিত কথা বলতেও ছাড়ি না। আর চোর বলে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করছেন কেন, চোর কি খেটে খায় না। আপনাদের চেয়ে তাদের খাটুনি বরং অনেক বেশি। আপনারা যখন নাকে তেল দিয়ে রাতে ঘুমোন তখন এই আমাদের রাত জেগে মেহনত করতে হয়। তার ওপর কাজের ঝুঁকিটাই কি কম? ধরা পড়লে গেরস্তের কিল, পুলিশের গুঁতো হজম করতে হয়, বরাত খারাপ হলে কড়া হাকিমের হাতে পড়ে হাজতবাসও আছে। চোর বলে কি মানুষ নই আমরা?”