- বইয়ের নামঃ ঝিকরগাছায় ঝাট
- লেখকের নামঃ শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
- প্রকাশনাঃ আনন্দ পাবলিশার্স (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ অদ্ভুতুড়ে সিরিজ
১. ঝিকরগাছার হাট
ঝিকরগাছায় ঝাট – অদ্ভুতুড়ে সিরিজ – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
ঝিকরগাছার হাট হল এ-তল্লাটের সেরা। একধারে গ্যাঁড়াপোতার খাল আর অন্য ধারে মহীনরাজার ঢিবি, মাঝখানে বিশাল চত্বর জুড়ে রমরম করছে হাটখানা। এখানে না পাওয়া যায় এমন জিনিস কমই আছে। পরগনার সব ব্যাপারিই এসে জোটে। তেমনই খরিদ্দারের ভিড়। যেমন বিকি, তেমনি কিনি। সকাল থেকে রাত অবধি কত টাকাপয়সা যে হাতবদল হয় তার লেখাজোখা নেই।
তা বলে সবাই যে এসে ঝিকরগাছার হাটে পয়সা কামিয়ে নিয়ে যায় বা জিনিসপত্র কিনতে পারে তা নয়। ওই যে নবগ্রামের রসো পান্তি মুখোনা হাসি হাসি করে গন্ধবণিকদের দোকানের সামনে ঘোরাঘুরি করছে আর চতুর চোখে চারদিকে চাইছে, কিন্তু বিশেষ সুবিধে করে উঠতে পারছে না। হরিহরপুরের প্রসন্ন হালদারের কোমরের গেজেতে না হোক আজ তিন-চার হাজার টাকা আছে। হালদারের পো-র পাটের দড়ির কারখানা। ঝিকরগাছার হাটে ফি হাটবারে শস্তায় পাটের গুছি কিনতে আসে। তা সেই গেজেটাই তাক করে অনেকক্ষণ ধরে তক্কে তক্কে ঘুরছে রসো। সঙ্গে চেলা হাদু। গেজেটা গস্ত না করলে চেলার কাছে মান থাকবে না। কিন্তু রসো পান্তির সেই দিন আর নেই। বয়স হওয়ায় হাত-পা তেমন চলে না। আর লোকজনও ক্রমে সেয়ানা হয়ে উঠছে।
হাদু বিরক্ত হয়ে বিড়বিড় করছিল, “সকাল থেকে কেবল হাঁটাহাঁটিই সার হচ্ছে যে! কাজকারবার কিছুই হল না।”
“হবে রে হবে। ব্যস্ত হলে কি হয়?” প্রসন্নর সঙ্গে ওর শালা
রেমোটাও রয়েছে। সর্বদা চোখে চোখে রাখছে। প্রসন্নর কোমরখানার দিকেই ওর চোখ। “একটু ধৈর্য ধর বাবা, রেমোর খিদে বা জলতেষ্টা পেলে বা চেনাজানা কারও সঙ্গে দেখা হলেই হয়। একটু আনমনা হলেই দেখবি চোখের পলকে প্রসন্নর কোমর সাফ হয়ে যাবে।”
“ধুর মশাই, এত বড় হাটে কি আর প্রসন্ন ছাড়া মুরগি নেই? কত লোকে তো পকেটে টাকা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে! একটা ছোটখাটো দাও মারলেও জিলিপি শিঙাড়াটা হয়ে যায়।”
কথাটা মিথ্যে নয়। এসব কাজকারবারে একজনকে নিয়ে পড়ে থাকলে হয় না। মা-লক্ষ্মী নানা ট্যাঁকে এবং পকেটে ছড়িয়ে রয়েছেন। তবে রসো পান্তির স্বভাব হল, যাকে দেগে রাখবে তাকেই তাক করবে। ওভাবেই বরাবর বউনি করে এসেছে। বউনিটা ভাল হলে সারা দিনে ভালই দাও মারা যায়।
রসো পান্তির এখন খুবই দুর্দিন। যখন বয়সকালে হাত এবং মাথা সাফ ছিল তখন চেলাচামুণ্ডাও জুটত মেলা। কিন্তু এখন নানা নতুন ওস্তাদের আবির্ভাব হওয়ায় বেশিরভাগ চেলাই কেটে পড়েছে। শিবরাত্রির সলতে এখন ওই হাদু। সেও কেটে পড়লে রসোর আর চেলা থাকবে না। খুবই চিন্তার বিষয়। ঘঁদুকে তাই তুইয়ে বুইয়ে রাখতে হয়। সে শুনেছে, সিংহ নাকি একটা শিকারকেই তাক করে ধরে। সেটাকে ধরতে না পারলে অন্য শিকার ছোঁয় না। দিনেকালে সে সিংহ ছিল বটে, কিন্তু এখন আর শেয়াল ছাড়া কীই বা বলা যায় তাকে।
রসো একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, “তাই হবে রে বাপু, তুই মাথা গরম করিস না।”
দু হঠাৎ উত্তেজিত গলায় বলে, “ওই দেখুন, নবু পালের পানের দোকানের সামনে কেমন বাবু চেহারার একটা লোক দাঁড়িয়ে পান খাচ্ছে। বাহারি চেহারাখানা দেখেছেন?”
তা দেখল রসো। বাবরি চুল, লম্বা জুলপি, গায়ে জরির কাজ করা সিল্কের পাঞ্জাবি, পরনে ধাক্কাপেড়ে ধুতি। তাগড়াই চেহারা, তাগড়াই মোচ। রাজা-জমিদারের বংশ বলেই মনে হয়। মুখটা চেনা নয়। এ-তল্লাটে নতুন উদয় হয়েছে বলেই মনে হয়।
নবুর পান খুব বিখ্যাত। হাঁচি পান, মিঠে পাত্তি বা বেনারসি পাত্তি যা চাও পাবে। মশলাও শতেক রকমের। ট্যাঁকে পয়সা না থাকলে নবুর পান হল আকাশের চাঁদ। তবে যেসব হাটুরে দু’পয়সা কামাতে পারে তারা সদানন্দর রাবড়ি বা মালপোয়া, গদাধরের মাছের চপ, হরিপদর জিবেগজা আর পালোধি, রঘুপতির মালাই সন্দেশ কিংবা লেডিকেনি, বটকৃষ্ণর তেলেভাজা আর ঘুঘনি খেয়ে আইঢাই হয়ে নবুর একখিলি পান মুখে না দিলে আরাম বোধ করে না। সে এমন মশলাদার পান যে, মুখে দিলে বিশ হাত জুড়ে গন্ধ ছড়াতে ছড়াতে যায়।
লোকটা পান মুখে দিয়ে নিমীলিত নয়নে তাচ্ছিল্যের সঙ্গেই চারধারটা দেখছিল।
হাদু উত্তেজিত গলায় বলে, “এ একেবারে রাজাগজা লোক। এবার একটু হাতের খেল দেখিয়ে দিন মশাই।”
রসো মৃদু গলায় বলে, “দাঁড়া বাপু, লোকটাকে আগে জরিপ করতে দে। হুট করে গিয়ে ঘাই মারলেই তো হবে না। হাবভাব একটু বুঝি। সেয়ানা না বোকা, ভ ভদ্রলোক না ভদ্রবেশী জোচ্চোর, সেসবও আঁচ করতে হয়, বুঝলি। এ-লাইন বড় কঠিন।”
হাদু বিরক্ত হয়ে বলে, “আপনাকে দিয়ে কিছু হবে না মশাই। হরু দাস বা জগা হাটি হলে এতক্ষণে কাজ ফরসা হয়ে যেত।”
রসো অর্থাৎ রসময় পান্তি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। না, হাঁদুকে রাখা যাবে না শেষ অবধি। যদিও বটে বটতলার হরু দাস আর রাঘবপুরের জগা হাটি ইদানীং খুব নাম করেছে। রাঘবপুরের দারোগা গোবিন্দ কুন্ডু পর্যন্ত প্রকাশ্যে স্বীকার করেছেন, হ্যাঁ, জগা হাটির মতো চালাকচতুর চোর তিনি ইহজন্মে দেখেননি। মোদ্দা কথাটা হল, নতুন যুগের এরা সব উদয় হচ্ছে আর পুরনো আমলের রসো পান্তি অস্ত যাচ্ছে। সুতরাং দু একদিন সটকাবেই। বড় মায়া পড়ে গেছে ছেলেটার ওপর, তাই বুকটা টনটন করে বটে। এও ঠিক কথা, হুট করে কিছু করে ওঠা রসোর পদ্ধতি নয়। আগে শিকারকে নজরে রাখা, মাপজোক করা, সবলতা দুর্বলতার আঁচ করা, তারপর ফাঁক বুঝে কাজে নেমে পড়াই হল তার চিরকেলে নিয়ম। কাজ ভন্ডুল হলে কপালে হাটুরে কিল, চাই কি পুলিশের গুঁতো এবং হাজতবাসও জুটতে পারে। কিন্তু নওজোয়ান হাঁদু ব্যাপারটা বুঝতে চাইছে না।