- বইয়ের নামঃ চক্রপুরের চক্করে
- লেখকের নামঃ শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
- প্রকাশনাঃ আনন্দ পাবলিশার্স (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ অদ্ভুতুড়ে সিরিজ
১. সকালের আপ ট্রেন
চক্রপুরের চক্করে – অদ্ভুতুড়ে সিরিজ – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
সকালের আপ ট্রেন থেকে একটা লোক যখন লটবহর নিয়ে হুড়মুড়িয়ে চক্ৰপুর রেল স্টেশনে নেমে পড়ল তখন পোটার লাখন আর স্টেশনবাবু সতীশ দত্ত দুজনেই কিছু অবাক হয়েছিল। চক্ৰপুর নিতান্তই ব্রাঞ্চ লাইনের খুদে একটা স্টেশন। এখানে শহর গঞ্জ বলে কিছু এখন আর নেই। লোকজন বিশেষ যায়ও না, আসেও না।
লোকটার সঙ্গে একটা কালো ট্রাঙ্ক, একটা সুটকেস, একটা বেডিং, একটা টিফিন ক্যারিয়ার আর জলের বোতল। লাল মোরামের প্ল্যাটফর্মে জিনিসপত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে লোকটা বোকার মতো ইতিউতি চাইছে দেখে সতীশ একটু এগিয়ে গেল।
“কুলি খুঁজছেন নাকি? এখানে কিন্তু কুলিটুলি পাবেন না। …”
লোকটা দেখতে সরল সোজা ভালমানুষের মতো। রংটি কালো, বেশ মোটাসোটা, মস্ত গোঁফ আছে, পরনে ধুতি আর সাদা শার্ট। সতীশের দিকে করুণ নয়নে চেয়ে লোকটা একটু চাপা গলায় বলল, “এখানে একটু লুকিয়ে থাকার জায়গা পাওয়া যাবে?”
সতীশ অবাক হয়ে বলে, “লুকিয়ে থাকবেন? লুকিয়ে থাকবেন কেন?”
লোকটা একটা সবুজ রুমালে মুখটা ঘষে-ঘষে মুছতে মুছতে বলল, “আমার বড় বিপদ যাচ্ছে মশাই। একটা খুনের মামলায় সাক্ষী দিয়ে এমন ফেঁসে গেছি যে, আর কহতব্য নয়। তা এখানে একটু গা-ঢাকা দিয়ে থাকার ব্যবস্থা নেই?”
লোকটার ভাবভঙ্গি আর কথা বলার ধরন এমন যে, বিপদের কথা শুনেও সতীশের একটু হাসি পেয়ে গেল। হাসিটা চেপে সে গম্ভীর হয়ে বলল, “লুকিয়ে থাকা তো দূরের কথা, এখানে মাথা গোঁজার জায়গাই নেই। চক্ৰপুরে এসে আপনি ভুল করেছেন।”
লোকটা হতাশ হয়ে ধপ করে ট্রাঙ্কের ওপর বসে পড়ল। তারপর আপন মনে মাথা নেড়ে বলল, “ভুল করাটাই আমার স্বভাব কিনা। যা-ই করতে যাই সেটাতেই গণ্ডগোল। তা এটা ঠিক ঠিক চক্রপুরই বটে তো?”
“আজ্ঞে, এটা ঠিক-ঠিক চক্রপুরই বটে। ওই তো স্টেশনের সাইনবোর্ডে লেখাও আছে।”
লোকটা ঘাড় নেড়ে বলে, “তা হলে জায়গাটা ভুল করিনি বোধ হয়। এইখানেই আমাদের আদি বাড়ি ছিল। যদিও পঞ্চাশ-ষাট বছর হল বসবাস উঠে গেছে। এখানে শুখানালা বলে একটা জায়গা আছে কি?”
সতীশ ভ্রূ কুঁচকে বলল, “শুখানালা? নামটা শোনা-শোনা মনে হচ্ছে। তবে ঠিক,..”
কখন লাখন এসে পেছনে দাঁড়িয়ে ছিল। এবার সে বলল, “হ হাঁ, শুখানালা জরুর হ্যাঁয়। হুই দিকে যো শালজঙ্গল আছে, তার ভিতরে। উখানে তো এখুন জঙ্গল ছাড়া কুছু নাই।”
লোকটা মাথা নেড়ে বলে, “এরকমই হওয়ার কথা। কবে
বসত উঠে গেছে, বাড়িঘরও নিশ্চয়ই লোপাট। আমি অবশ্য কখনও আসিনি এখানে। তবে বাপ ঠাকুদার মুখে চক্ৰপুরের কথা শুনেছি।”
সতীশ বলে, “তা এখন আপনি বেন কি? শুখানালায় পৈতৃক বাড়ির সন্ধানে যাবেন নাকি?”
লোকটা দুশ্চিন্তায় তোম্বা মুখোনা নিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “আমার যা বিপদ যাচ্ছে সে আপনাদের বোঝাতে পারব না। আচ্ছা, এখানে কোনও সদাশয় সাহসী লোককে কি পাওয়া যাবে, যে প্রয়োজনে একটু-আধটু মিথ্যে কথা বলতে পারে?”
সতীশ এবার আর হাসি চাপতে পারল না। পরমুহূর্তেই গম্ভীর হয়ে বলল, “এরকম লোক দিয়ে কী করবেন?”
লোকটা কাঁচুমাচু হয়ে বলে, “সদাশয় না হলে আমাকে আশ্রয় দেবে না, সাহসী না হলে বিপদ-আপদ ঠেকাবে কে, আর মিথ্যে কথা না বললে আমাকে বাঁচানো সহজ হবে না। পানু মল্লিকের দল আমাকে হন্যে হয়ে খুঁজছে।”
সতীশ এবার আরও একটু গম্ভীর হয়ে বলে, “তা হলে বলতেই হয়, আপনি এখানে এসে ভুল করেছেন। এখানে মানুষজনের বসতি বিশেষ নেই। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দু-চারঘর মানুষ আছেন বটে, কিন্তু সেখানে সুবিধে হবে না।”
লোকটা মাথা চুলকোতে-চুলকোতে মহা-ভাবিত হয়ে বলল, “তা হলে তো খুব মুশকিল হল মশাই। এ তো দেখছি বেঘরে প্রাণটা যাবে। ভেবেছিলুম পৈতৃক ভিটেয় এসে পড়লে পাড়া-প্রতিবেশীরা ফেলবে না। এ তো দেখছি পাড়াই নেই। এখন কী করা যায় একটু বলতে পারেন?”
সতীশের একটু মায়া হল। লোকটার মুখচোখে বিপন্ন ভাব দেখে সে বলল, “এ-বেলাটা আমার কোয়াটারে বিশ্রাম নিতে পারেন। তারপর ভেবে দেখা যাবে।”
লোকটা বেজার মুখ করে বলে, “স্টেশন বড় উদোম জায়গা। লোকের নজরে পড়ে যাওয়ার ভয় আছে।”
“তা হলে কী করবেন?”
“আচ্ছা, এখানে কি চোর-ছ্যাঁচড়ের খুব উৎপাত আছে? না থাকলে মালপত্রগুলো স্টেশনেই রেখে আমি বরং বাপ-পিতেমোর ভিটেটাই একটু দেখে আসি। তারপর যা হওয়ার হবে। কী বলেন।”
লাখন এবার এগিয়ে এসে বলে, “আহা-হা, জঙ্গলে গিয়ে হোবেটা কি? দু-চারটো রোটি খেয়ে লিন, একটু চা-পানি ভি পিয়ে লিন, তারপর ঘুমনে যাবেন।”
কিন্তু লোকটার এমনই অবস্থা যে, এসব ভাল প্রস্তাব গ্রহণই করতে পারছে না। মাথা নেড়ে বলে, “না বাবা না, পরের গাড়িতেই পানু মল্লিকের খুনে গুণ্ডারা চলে আসতে পারে। স্টেশন বড় ভয়ের জায়গা।”
সতীশ বলে, “পরের গাড়ি সেই সন্ধের পর। আপনার কোনও ভয় নেই। তা ছাড়া একা-একা জঙ্গলে ঘুরে শুখানালা খুঁজে বের করাও সহজ নয়। এ-বেলাটা কাটিয়ে ও-বেলায় গাঁয়ের লোক বা রাখাল-ছেলে কাউকে সঙ্গে দিয়ে দেবখন।”