- বইয়ের নামঃ গুপির গুপ্তখাতা
- লেখকের নামঃ লীলা মজুমদার
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
০১. অনেক দিন আগের ঘটনা
০১.
অনেক দিন আগের ঘটনা, ভুলে যাব মনে করে সব এই লিখে দিলাম। রোজ রোজ একরকম হত, হঠাৎ একদিন এমনি হল যে মনে করলে এখনও গা শিরশির করে।
একটা গাড়িতে ঠানদিদি, শ্যামাদাসকাকা, বিরিঞ্চিদা আর আমি!
গাড়ি চলেছে তো চলেইছে, থামবার নামটি করে না। এদের কি খিদে-তেষ্টাও পায় না? সঙ্গে কিছু নেই তা তো নয়। ওই টিফিন-ক্যারিয়ার একদম বোঝাই করা এই বড়ো বড়ো চপ লুচি আলুরদম শোনপাপড়ি।
খিদের চোটে পেটটা ব্যথা ব্যথা করছে। উঠেছি সেই কোন ভোরে; তত সকালে কখনো আমার ঘুম ভাঙে না। কাকেরা ডাকেনি, যারা রাস্তায় জল দেয় তারা আসেনি, আকাশ তখনও নীল হয়নি, তারারা নেবেনি, বগাই ওঠেনি, খাটের পায়ার কাছে নাক ডাকাচ্ছে আর ঘুমের ঘোরেই একটু একটু ল্যাজ নাড়াচ্ছে।
বগাইয়ের জন্য খুব খারাপ লাগছে। বেশ আমার পাশে কুণ্ডলী পাকিয়ে বসে থাকত। কাউকে কিছু করত না।
অত ভোরে উঠতে হয় না। পাশ ফিরে আবার ঘুমুতে যাব, এমনি সময় কানে এল খুটখুট ঠুকঠাক গুজগুজ ফিসফিস। মনে হল ঘর কথা কইছে, ঘরের বাইরের কেষ্টচুডোর গাছ কথা কইছে। এত কথা বলাবলির মধ্যে ঘুমুই কী করে?
উঠে পড়লাম। দোর গোড়ায় গিয়ে দেখি কিনা আমার ঠানদিদি সারা গায়ে চাদর মুড়ি দিয়ে, মস্ত এক পুটলি বগলে ফস ফস করে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে যাচ্ছেন।
আর কথাটি নয়, ছুটে গিয়ে পেছন থেকে ঠানদিদিকে জাপটে ধরলাম। ঠানদিদি এমনি চমকে গেলেন যে আরেকটু হলে পড়েই যাচ্ছিলেন। তবেই হয়েছিল আর কী! চ্যাঁচামেচি করে একাকার কাণ্ড করতেন, তখন যাওয়া-টাওয়া সব বন্ধ!
আমি বললাম, কোথায় যাচ্ছ তোমরা?
কোনোরকমে সামলিয়ে নিয়েই আমার মুখ চেপে ধরে ঠানদিদি বললেন, স-স-স-স।
বলে আঙুল দিয়ে সিঁড়ির নীচেটা দেখিয়ে দিলেন।
সিঁড়ির নীচে দুটো লোক হাতছানি দিয়ে ঠানদিদিকে ডাকছে। দেখলাম তারা হল পাশের বাড়ির বিরিঞ্চিদা আর আমার শ্যামাদাসকাকা। তা হলে কী হবে, আমাকে দেখে সবাই কী বিরক্ত! একে আবার কেন আনা হল? এখুনি সব মাটি করে দেবে।
রেগে চেঁচিয়ে বললাম, বেশ, বেশ, আমি নাহয় ফিরেই যাচ্ছি। সেজোদাদামশাইকে গিয়ে সব বলে দিচ্ছি– ও সেজোদাদু
অমনি সব ভোল বদলে গেল, তখন আমাকে সে কী সাধাসাধি! লক্ষ্মীটি চুপ কর। চল তোকে কাটলেট খাওয়াব, গাড়ির মধ্যে চেয়ে দ্যাখ, টিফিন-ক্যারিয়ারে ভরতি চপ কাটলেট ডিমের ডেভিল। কারো কাছে কিছু বলিসনি কিন্তু।
অবাক হয়ে দেখি গলির মুখে সত্যি সত্যি বিরিঞ্চিদাদার রংচটা পুরোনো ফোর্ড গাড়িটা দাঁড়িয়ে। ভেতরে মেলা জিনিস আর একটা বিরাট পেতলের টিফিন-ক্যারিয়ার।
মাথার ওপরে চেয়ে দেখি আকাশের রং একটু ফিকে হয়ে এসেছে, তার ওপর দিয়ে কালো এক ঝাঁক পাখি বাঁকা হয়ে উড়ে যাচ্ছে, তাদের ডানার ঝাপটানি শুনতে পেলাম।
আর বলতে হল না। এক দৌড়ে ওপরে গিয়ে নতুন জুতোটা পরে নিলাম, একটা প্যান্ট শার্ট নিলাম, চোখেমুখে জল দিয়ে, ভালো করে চুলটা আঁচড়ে, লাট্টু লেত্তি, খুদে আয়না-চিরুনি ইত্যাদি দরকারি জিনিস পকেটে পুরে, তিন মিনিটের মধ্যে গাড়িতে গিয়ে চেপে বসলাম। মা বাবা বোম্বাই গেছেন, পুটলিও গেছে সঙ্গে, কাউকে কিছু বলতেও হল না। নইলে আর যাওয়া হয়েছিল!
এসে দেখি বিরিঞ্চিদা ঘন ঘন হাতঘড়ি দেখছে, যেন আমার জন্য কতই-না দেরি হয়ে গেছে। সেধে তো সঙ্গে নিয়েছ বাপু, এখন তেজ দেখালে চলবে কী করে! বুকটা একটু একটু ঢিপ ঢিপ করছিল; এখন এই শেষ মুহূর্তে ধরা পড়লেই তো সব পন্ড! সেজোদাদুর নাকি ইঁদুরের পায়ের শব্দে ঘুম ছুটে যায়।
কিন্তু কিছু হল না। বিরিঞ্চিদার গাড়ি, তবে বিরিঞ্চিদা দারুণ ক্যাবলা, গাড়ি চালাতে ভয় পায়! তাই শ্যামাদাসকাকা চালাচ্ছে। আমি গিয়ে তার পাশে বসলাম। পারলে আমি কখনো পেছনে বসি না। শ্যামাদাসকাকা খুব ভালো গাড়ি চালায়, স্টার্ট দিতে এতটুকু আওয়াজ হল না। ওই তো লড়বড়ে গাড়ি, মনে হয় চলতে গেলে এখনি সব খুলে খুলে পড়ে যাবে।
কাছাকাছি কোথাও নয়, চলোম সটান কলকাতার বাইরে। পথঘাট ভোঁ ভোঁ, এত ভোরে কারো ঘুম ভাঙেনি। মাটি থেকে এক হাত ওপরে একটা ধোঁয়ামতো বিছিয়ে রয়েছে। ঠান্ডা ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছে।
আস্তে আস্তে ভোর হয়ে এল, পূর্ব দিক ফর্সা হবার আগেই দেখলাম পশ্চিম দিকটা লাল হয়ে উঠেছে। গোয়ালঘরে সব গোরুরা ডাকতে লাগল, এখান থেকে ওখান থেকে মুরগিরা বেরিয়ে এল। গাঁয়ের লোকদের জেগে ওঠা দেখতে পেলাম।
গাড়িতে কেউ কথা বলে না। এমনিতেই বিরিঞ্চিদার গাড়িতে এমনই দারুণ শব্দ হয় যে খুব না চ্যাঁচালে কিছু শোনা যায় না। তার ওপর মনে হল এদের সবার মনে যা ভয়। দু-একবার জিজ্ঞেস করলাম, কিন্তু কেউ কিছু বলে না, উলটে সে কী ধমক-ধামক করতে লাগল। কী দরকার রে বাবা। তোরা ভয় পেলে আমার আর কী!
খিদে খিদে পাচ্ছিল; কাল রাতে পিসিমার কড়াইতে আঠা তৈরি করা নিয়ে রাগমাগ করে ভালো করে খাইনি, তায় এখন কত বেলা হয়ে যাচ্ছে, কেউ খাওয়া-টাওয়ার কথা বলে না কেন?
নড়ছি-চড়ছি, এমনি সময় বিরিঞ্চিদা আমার কানের কাছে মুণ্ডুটা এনে বলল, এই চুপ করে বোস-না, বেশি কথাটথা বলিস না, তাহলে তোকে এই এত বড়ো একগাদা চুইংগাম দেব!