- বইয়ের নামঃ সানাউল্লাহর মহাবিপদ
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- প্রকাশনাঃ সাগর পাবলিশার্স
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
সানাউল্লাহ কৃষি ব্যাংকের ম্যানেজার
সানাউল্লাহ কৃষি ব্যাংকের ম্যানেজার হিসেবে রিটায়ার করেছেন। অতীশ দীপঙ্কর রোডে একটা টিনশেড বাড়িতে একা থাকেন। সবাইকে বলে বেড়ান–সুখে আছিরে ভাই, মহাসুখে আছি। ব্যাংকের হিসাব মিলানোর ঝামেলা নাই, হাজিরা দেবার ঝামেলা নাই। পায়ের ওপর পা তুলে সুখে জীবনপাত। আমার মতো সুখী বাংলাদেশে আরো আছে বলে মনে হয় না।
তার কাজের ছেলের নাম রফিক। সে বাজার করে, রান্না করে এবং রাতে খাবার পর সানাউল্লাহর সঙ্গে ডিভিডি প্লেয়ারে হিন্দি ছবি দেখে। তিনি রফিককেও প্রায়ই বলেন, রফিক, এর নাম সুখ। ইংরেজিতে বলে হ্যাপিনেস। দিনের শেষে আরাম করে ছবি দেখা, রাত দশটায় ঘুমুতে যেতে হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। প্রয়োজনে এক রাতে পরপর তিনটা ছবি দেখতে পারি। কিংবা সন্ধ্যাবেলা ঘুমিয়ে পড়তে পারি। পারি না?
পারেন স্যার।
মনে কর এক রাতে আমরা অমিতাভ বচ্চনের তিনটা ছবি দেখলাম। রাতটার নাম দিলাম অমিতাভ নাইট। নাইট মানে রাত। অমিতাভের রাত। কেমন হয়?
রফিক সব দাঁত বের করে বলল, ভালো হয় স্যার। বুড়া ভালো পাঠ গায়। উনার তিনটা বই কবে দেখব স্যার?
আগামীকাল রাতেই দেখা যেতে পারে। আগামীকাল হচ্ছে শুক্রবার। উইক এন্ডের শুরু। যদিও আমার জন্যে প্রতিদিনই উইক এন্ড। বিশেষ খাবার দাবারের ব্যবস্থা কর। পোলাও আর খাসির মাংসের রেজালা।
সাথে ইলিশ মাছের ভাজি দিব স্যার?
দিতে পারিস। পোলাও আর ইলিশ এক সূতায় গাঁথা মালা।
শুক্রবার সকালে রফিক বাজারের টাকা এবং ডিভিডি প্লেয়ার নিয়ে পালিয়ে গেল। অমিতাভের তিনটা সিডি তিনি আলাদা করে রেখেছিলেন। সেগুলিও নিয়ে গেল।
সানাউল্লাহ বললেন, ভেরি স্টুপিড বয়। সানাউল্লাহ সুপিডের চেয়ে খারাপ কোনো গালি দিতে পারেন না। রফিককে স্টুপিড় গালি দিয়েও তার একটু মন খারাপ হলো। কারণ রফিককে তিনি পছন্দ করতেন। পছন্দের মানুষকে গালাগালি করা ঠিক না। রফিক একটা খারাপ কাজ করেছে বলে তিনিও করবেন তা কেমন করে হয়?
সানাউল্লাহ ভালো ঝামেলায় পড়লেন। রাতে তাজ রেস্টুরেন্টে খেতে গেলেন। অতিরিক্ত মসলা এবং ঝাল দেয়া খাবার। মোটেও ভালো লাগল না।
বাসায় ফিরে তিন চামচ চিনি খেলেন, তাতেও মুখের ঝাল দূর হলো না। তিনি ফ্যান ছেড়ে হা করে ফ্যানের দিকে তাকিয়ে রইলেন। যদি ফ্যানের বাতাসে ঝাল ভাব কিছু কমে। এই সময় এক কান্ড হলো। তার খাটের নিচে খচমচ শব্দ হতে লাগল। তিনি নিচু হয়ে তাকালেন। অবাক হয়ে দেখলেন, ছয় সাত বছরের একটা বাচ্চা চুপচাপ বসে আছে। মায়াকাড়া চেহারা। বড় বড় চোখ। দীর্ঘ আঁখি পল্লব। মাথাভর্তি কোঁকড়ানো চুল। গায়ের রঙ স্ফটিকের মতো সাদা।
তিনি অবাক হয়ে বললেন, তুই কেরে?
ছেলেটা ফিস ফিস করে বলল, আস্তে কথা বলুন। ঘুম ভেঙে যাবে তো।
কার ঘুম ভাঙবে?
আমার বোনের। ওর নাম ডমরু।
তিনি খাটের নিচে ছেলেটি ছাড়া কাউকে দেখলেন না। অবাক হয়ে বললেন, ড়ুমরু কই?
ছেলেটি বলল, ও ভূত তো, এইজন্যে ওকে দেখছেন না।
তুই কী?
আমিও ভূত। আমার নাম হম। আমাকে দেখতে পাচ্ছেন কারণ আমি বড়। মানুষের বেশ ধরতে শিখেছি। ও এখনো শিখে নি। আপনার ঘরে কি মধু আছে?
মধু কী করবি?
খাব।
মধু তো নাই। চিনি দেব? চিনি খাবি?
এক চামচ দিন।
তোর বোনটা কী করছে?
ও ঘুমাচ্ছে। জ্বর এসেছে তো, এইজন্যে ঘুমাচ্ছে।
সানাউল্লাহ বললেন, ভূতদের জ্বর হয়?
হমড়ু বলল, জ্বর হয়, সর্দিকাশি হয়। যান এক চামচ চিনি নিয়ে আসুন, ক্ষিধে লেগেছে।
সানাউল্লাহ রান্নাঘরের তাকে চিনি খুঁজতে গিয়ে থমকে গেলেন। তিনি এইসব কী করছেন? ভূত আসবে কোত্থেকে? কারোর বাচ্চাছেলে রাগ করে বাসা থেকে পালিয়ে তার ঘরের খাটের নিচে বসে আছে। এই সহজ জিনিসটা না বুঝে তিনি ভূত বিশ্বাস করে বসে আছেন। তিনি পরপর দুবার বললেন, সানাউল্লাহ, তুমি স্টুপিড। তুমি হচ্ছ, এ ভেরি স্টুপিড ম্যান।
তারপরেও তিনি রান্নাঘর থেকে বড় তরকারির চামচভর্তি চিনি নিয়ে ফিরলেন। মানুষের বাচ্চা হোক, ভূতের বাচ্চা হোক, খেতে চেয়েছে খাক।
সানাউল্লাহ চিনি নিয়ে শোবার ঘরে এসে দেখেন খাটের নিচে কেউ নেই। তাহলে একটু আগে যা দেখেছেন সবই ভুল। সানাউল্লাহ এদিক ওদিক তাকিয়ে ডাকলেন, এই এই।
সঙ্গে সঙ্গে খাটের নিচে ছেলেটাকে দেখা গেল। সে হামাগুড়ি দিয়ে বেরু হয়ে 51
কই ছিলি?
এখানেই ছিলাম। মানুষের বেশ ধরে বেশিক্ষণ থাকতে পারি না।
সানাউল্লাহ বললেন, নে চিনি খা।
বাচ্চাটা চিনির চামচ নিয়ে খাচ্ছে। চিনির কিছু দানা মেঝেতে পড়ে গিয়েছিল। সেগুলিও সে তুলে মুখে দিল।
সানাউল্লাহ বললেন, বোনটাকে দে।
ও চিনি খেতে পারে না, শুধু মধু খায়।
সানাউল্লাহ বললেন, সারারাত না খেয়ে থাকবে?
অসুবিধা নাই।
সানাউল্লাহ বললেন, অসুবিধা নাই মানে? ফাজিল ছেলে। ছোটবোন না খেয়ে থাকবে! নিজে তো গবগ করে চিনি খাচ্ছিস। লজ্জা নাই।
এখন করব কী বলুন? সানাউল্লাহ প্যান্ট খুঁজতে লাগলেন। দোকানে যাবেন। মধু পাওয়া যায় কিদেখবেন। এত রাতে দোকান খোলা থাকার কথা না। তারপরেও চেষ্টা তো নিতে হবে। সানাউল্লাহ বললেন, তোর নাম কী যেন বললি, হমডু না?
হমডু।
তোরা এখানে এসেছিস কীভাবে?