- বইয়ের নামঃ সাজঘর
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- প্রকাশনাঃ প্রতীক প্রকাশনা সংস্থা
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
কেরোসিনের চুলায় জাম্বো সাইজের এক কেতলি
কেরোসিনের চুলায় জাম্বো সাইজের এক কেতলি। মনজু পাশে বসে আছে–একটু পর পর কেতলির মুখ তুলে পানি ফুটছে কিনা তা দেখার চেষ্টা করছে। তার হিসেবমত ইতিমধ্যে পানি ফুটে যাওয়া উচিত। অথচ ফুটছে না। ব্যাপারটা কি?
মজনুর বয়স তেরো-চৌদ্দ কিন্তু দেখায় অনেক বেশি। তার মুখ চিমসে গিয়েছে, গালের হাড় উঁচু, মাথার চুল জায়গায় জায়গায় পড়ে গেছে। উপরের পাটির দু’টি দাঁত ভাঙা। ভাঙা দাঁতের ফাক দিয়ে পিচ করে থুথু ফেলা ছাড়া তার মধ্যে আর কোনো ছেলেমানুষি নেই।
মজনু পূর্বা নাট্যদলের টি বয়। এদের সঙ্গে সে গত তিন বছর ধরে লেগে আছে। তার কাজ হচ্ছে রিহার্সেল চলাকালীন সময়ে একশ থেকে দেড়শ কাপ চা বানানো। এর বিনিময়ে মাসে সে নকবুই করে টাকা পায় এবং রিহার্সেলের এই ঘরে রাতে ঘুমুতে পারে। এমন কোনো লোভনীয় চাকরি নয়। প্রতি সপ্তাহে মজনু একবার করে ভাবে চাকরি ছেড়ে দেবে। ছাড়তে পারে না। তার নেশা ধরে গেছে। রিহার্সেল না শুনলে তার ভাল ঘুম হয় না। বৃহস্পতি এবং শুক্র এই দু’দিন রিহার্সেল হয় না। মজনুর খুব অস্থির লাগে। আগামীকাল বৃহস্পতিবার এই কথা ভেবে এখন থেকেই মজনুর মেজাজ খারাপ। মেজাজ খারাপ হলে সে কিছুক্ষণ পর পর দাঁতের ফাঁক দিয়ে থুথু ফেলে। এখনো ফেলছে এবং আড়ে আড়ে দরজার দিকে তাকাচ্ছে। কেউ দেখে ফেললে কপালে যন্ত্রণা আছে। তার থুথু ফেলা কেউ সহ্য করে না।
প্রণব বাবু দরজা দিয়ে ঢুকলেন। মজনু অতিরিক্ত গম্ভীর হয়ে পড়ল। প্রণব বাবুকে সে দুচোখে দেখতে পারে না। তার সঙ্গে চোখাচোখি হলেই সে মনে মনে বলে, হারামজাদা মালাউন।
মজনু।
মজনু জবাব দিল না। তাকালও না।
মজনু, জল ফুটিল না কি রে?
না।
চুলায় আগুন আছে নাকি দেখ তো, তুই দেখি রাত বারোটা বাজাবি।
মজনু প্রণব বাবুর উল্টোদিকে মুখ নিয়ে খুব সাবধানে একদলা থুথু ফেলে মনে মনে বলল, হারামজাদা কুত্তা।
এই দলের দু’জন লোককে মজনু সহ্য করতে পারে না। একজন প্রণব বাবু, অন্যজন জলিল সাহেব। অথচ এই দু’জনই নিতান্ত ভােলমানুষ। বিভিন্ন উপলক্ষে মজনুকে টাকা পয়সা দেন।
প্রণব বাবু পকেট থেকে কুড়িটা টাকা বের করে মজনুর দিকে বাড়িয়ে দিলেন। মধুর স্বরে বললেন, পাঁচটা ফাইভ ফাইভ নিয়ে আয়। বিদেশী। যাবি আর আসবি।
মজনু বেরিয়ে গেল। বিদেশী সিগারেট আনতে তার খুব আগ্রহ। দেশীটাই সে কেনে, কেউ ধরতে পারে না। সব বেকুবের দল। অথচ তারা নিজেরা তা জানে না। পৃথিবীতে বোকার সংখ্যা এত বেশি কেন এই জিনিসটা নিয়ে প্রায়ই মজনু ভাবে।
রিহার্সেল হয়। পুরানা পল্টনের জনতা পারলিক লাইব্রেরির হল ঘরে। দুটো চৌকি একত্র করে একটা স্টেজ তৈরি করা আছে। এই পারলিক লাইব্রেবির প্রতিষ্ঠাতা পূর্বা নাট্যদলের সঙ্গে জড়িত বলে এখানে রিহার্সেলের সুযোগ পাওয়া যাচ্ছে। তবে বেশিদিন পাওয়া যাবে না। হল ঘরটা লাইব্রেরির রিডিং রুম হয়ে যাবে।
হল ঘরে নাটকের পাত্র-পাত্রীরা উপস্থিত হচ্ছে। মহড়া শুরু হতে দেরি হচ্ছে; কারণ আসিফ এখনো এসে উপস্থিত হয়নি। আসিফের স্ত্রী লীনা অনেক্ষণ হল এসেছে। অন্য কোনো মেয়ে এখনো উপস্থিত হয়নি।
লীনার বয়স পঁয়ত্ৰিশ ছাব্বিশ। তাকে কখনো সে রকম মনে হয় না। হালকা পাতলা গড়নের জন্য আঠারো-উনিশ বছরের তরুণীর মত মনে হয়। লীনার মুখটি স্নিগ্ধ। তবে আজ তাকে কিছুটা বিষন্ন দেখাচ্ছে। মিজান বসেছে লীনার পাশে। সে জিজ্ঞেস করল, ভাবী আপনার শরীরটা কি খারাপ?
লীনা জবাব না দিয়ে হাসল। যে হাসির মানে হচ্ছে শরীর ভালই আছে।
মিজান বলল, আসিফ ভাই দেরি করছেন কেন জানেন?
জানি।
লীনা আবার হাসল। তার হাসি রোগ আছে। যে কোনো কথা বলবার আগে একটু হলেও হাসে। এবং কথা কখনো পুরোপুরি বলে না।
মিজান বিরক্ত হয়ে বলল, জানলে বলুন। আপনি অর্ধেক কথা বলেন, অর্ধেক পেটে রেখে দেন, বড় বিরক্ত লাগে।
লীনা বলল, ও তার বোনের বাসায় যাবে। ওর ভাগ্লির শরীর খারাপ। ওখানেই মনে হয়ে দেরি হচ্ছে! মিজান ভ্রূ কুঁচকে বলল, কোনোদিন টাইমলি রিহার্সেল শুরু করতে পারিনা। কোনো মানে হয়?
লীনার বেশ মজা লাগছে; মিজানের কথা বলার ভঙ্গিটাই মজার। এমন ভাবে সে কথা বলে যেন পুরো নাটকের দায়িত্ব তার ঘাড়ে; অথচ সে এই বছরেই মাত্র গ্রুপে জয়েন করেছে। নাটকে এখনো কোনো রোল পায় নি। পাওয়ার সম্ভাবনাও কম। মিজানের গলাটা মেয়েলি। তবে এ নিয়ে তার কোনো ক্ষোভ নেই। সে যে লেগে থাকতে পারছে এতেই সে খুশি।
মিজানদের থেকে একটু দূরে জলিল সাহেব কয়েকজনের সঙ্গে নিচু গলায় আডিডা দিচ্ছেন। আডিডা ঠিক না। কথা বলছেন জলিল সাহেব একাই! অন্যরা খুব আগ্রহ নিয়ে শুনছে। আদিরসের গল্প। জলিল সাহেব আদিরস বিষয়ক রসিকতা অতি চমৎকার করেন। তবে সব সময় করেন না। এমন সময় করেন যখন আশপাশে মেয়েরা কেউ থাকে। আজ লীনা কাছেই আছে।
জলিল সাহেব সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, গল্পটা হচ্ছে একটা ভীমরুল নিয়ে। ভীমরুল হুঁল ফুটিয়ে দিয়েছে। ভীমরুল হুঁল ফোটালে কি হয় জানো তো? ফুলে বিশাল হয়ে যায়। এখন চিন্তা কর, একজন লোকের একটা বিশেষ জায়গায় যদি ভীমরুল হুঁল ফোটায় তাহলে?