- বইয়ের নামঃ প্রেম
- লেখকের নামঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
- বিভাগসমূহঃ রবীন্দ্রসংগীত
অজানা খনির নূতন মণির গেঁথেছি হার
অজানা খনির নূতন মণির গেঁথেছি হার,
ক্লান্তিবিহীনা নবীনা বীণায় বেঁধেছি তার॥
যেমন নূতন বনের দুকূল, যেমন নূতন আমের মুকুল,
মাঘের অরুণে খোলে স্বর্গের নূতন দ্বার,
তেমনি আমার নবীন রাগের নব যৌবনে নব সোহাগের
রাগিণী রচিয়া উঠিল নাচিয়া বীণার তার॥
যে বাণী আমার কখনো কারেও হয় নি বলা
তাই দিয়ে গানে রচিব নূতন নৃত্যকলা।
আজি অকারণ বাতাসে বাতাসে যুগান্তরের সুর ভেসে আসে,
মর্মরস্বরে বনের ঘুচিল মনের ভার।
যেমনি ভাঙিল বাণীর বন্ধ উচ্ছ্বসি উঠে নূতন ছন্দ,
সুরের সাহসে আপনি চকিত বীণার তার।
অজানা সুর কে দিয়ে যায় কানে কানে
অজানা সুর কে দিয়ে যায় কানে কানে,
ভাবনা আমার যায় ভেসে যায় গানে গানে॥
বিস্মৃত জন্মের ছায়ালোকে হারিয়ে-যাওয়া বীণার শোকে
ফাগুন-হাওয়ায় কেঁদে ফিরে পথহারা রাগিণী।
কোন্ বসন্তের মিলনরাতে তারার পানে
ভাবনা আমার যায় ভেসে যায় গানে গানে॥
অধরা মাধুরী ধরেছি ছন্দোবন্ধনে
অধরা মাধুরী ধরেছি ছন্দোবন্ধনে।
ও যে সুদূর রাতের পাখি
গাহে সুদূর রাতের গান॥
বিগত বসন্তের অশোকরক্তরাগে ওর রঙিন পাখা,
তারি ঝরা ফুলের গন্ধ ওর অন্তরে ঢাকা ॥
ওগো বিদেশিনী,
তুমি ডাকো ওরে নাম ধরে,
ও যে তোমারি চেনা।
তোমারি দেশের আকাশ ও যে জানে, তোমার রাতের তারা,
তোমারি বকুলবনের গানে ও দেয় সাড়া–
নাচে তোমারি কঙ্কণেরই তালে॥
অনেক কথা বলেছিলেম কবে তোমার কানে কানে
অনেক কথা বলেছিলেম কবে তোমার কানে কানে
কত নিশীথ-অন্ধকারে, কত গোপন গানে গানে॥
সে কি তোমার মনে আছে তাই শুধাতে এলেম কাছে–
রাতের বুকের মাঝে তারা মিলিয়ে আছে সকল খানে॥
ঘুম ভেঙে তাই শুনি যবে দীপ-নেভা মোর বাতায়নে
স্বপ্নে পাওয়া বাদল-হাওয়া ছুটে আসে ক্ষণে ক্ষণে–
বৃষ্টিধারার ঝরোঝরে ঝাউবাগানের মরোমরে
ভিজে মাটির গন্ধে হঠাৎ সেই কথা সব মনে আনে॥
অনেক কথা যাও যে ব’লে কোনো কথা না বলি
অনেক কথা যাও যে ব’লে কোনো কথা না বলি।
তোমার ভাষা বোঝার আশা দিয়েছি জলাঞ্জলি॥
যে আছে মম গভীর প্রাণে ভেদিবে তারে হাসির বাণে,
চকিতে চাহ মুখের পানে তুমি যে কুতূহলী।
তোমারে তাই এড়াতে চাই, ফিরিয়া যাই চলি।
আমার চোখে যে চাওয়াখানি ধোওয়া সে আঁখিলোরে–
তোমারে আমি দেখিতে পাই, তুমি না পাও মোরে।
তোমার মনে কুয়াশা আছে, আপনি ঢাকা আপন-কাছে–
নিজের অগোচরেই পাছে আমারে যাও ছলি
তোমারে তাই এড়াতে চাই, ফিরিয়া যাই চলি॥
অনেক দিনের আমার যে গান
অনেক দিনের আমার যে গান আমার কাছে ফিরে আসে
তারে আমি শুধাই, তুমি ঘুরে বেড়াও কোন্ বাতাসে॥
যে ফুল গেছে সকল ফেলে গন্ধ তাহার কোথায় পেলে,
যার আশা আজ শূন্য হল কী সুর জাগাও তাহার আশে॥
সকল গৃহ হারালো যার তোমার তানে তারি বাসা,
যার বিরহের নাই অবসান তার মিলনের আনে ভাসা।
শুকালো যেই নয়নবারি তোমার সুরে কাঁদন তারি,
ভোলা দিনের বাহন তুমি স্বপন ভাসাও দূর আকাশে॥
অনেক পাওয়ার মাঝে মাঝে কবে কখন একটুখানি পাওয়া
অনেক পাওয়ার মাঝে মাঝে কবে কখন একটুখানি পাওয়া,
সেইটুকুতেই জাগায় দখিন হাওয়া ॥
দিনের পর দিন চলে যায় যেন তারা পথের স্রোতেই ভাসা,
বাহির হতেই তাদের যাওয়া আসা।
কখন আসে একটি সকাল সে যেন মোর ঘরেই বাঁধে বাসা,
সে যেন মোর চিরদিনের চাওয়া ॥
হারিয়ে যাওয়া আলোর মাঝে কণা কণা কুড়িয়ে পেলেম যারে
রইল গাঁথা মোর জীবনের হারে।
সেই-যে আমার জোড়া-দেওয়া ছিন্ন দিনের খণ্ড আলোর মালা
সেই নিয়েই আজ সাজাই আমার থালা–
এক পলকের পুলক যত, এক নিমেষের প্রদীপখানি জ্বালা,
একতারাতে আধখানা গান গাওয়া ॥
অলকে কুসুম না দিয়ো
অলকে কুসুম না দিয়ো, শুধু শিথিল কবরী বাঁধিয়ো।
কাজলবিহীন সজল নয়নে হৃদয়দুয়ারে ঘা দিয়ো ॥
আকুল আঁচলে পথিকচরণে মরণের ফাঁদ ফাঁদিয়ো–
না করিয়া বাদ মনে যাহা সাধ, নিদয়া, নীরবে সাধিয়ো ॥
এসো এসো বিনা ভূষণেই, দোষ নেই তাহে দোষ নেই।
যে আসে আসুক ওই তব রূপ অযতন-ছাঁদে ছাঁদিয়ো।
শুধু হাসিখানি আঁখিকোণে হানি উতলা হৃদয় ধাঁদিয়ো ॥
অলি বার বার ফিরে যায়
অলি বার বার ফিরে যায়, অলি বার বার ফিরে আসে–
তবে তো ফুল বিকাশে॥
কলি ফুটিতে চাহে ফোটে না, মরে লাজে মরে ত্রাসে।
ভুলি মান অপমান, দাও মন প্রাণ, নিশি দিন রহো পাশে।
ওগো, আশা ছেড়ে তবু আশা রেখে দাও, হৃদয়রতন-আশে।
ফিরে এসো ফিরে এসো– বন মোদিত ফুলবাসে।
আজি বিরহরজনী, ফুল্ল কুসুম শিশিরসলিলে ভাসে॥
অশান্তি আজ হানল এ কী দহনজ্বালা
অশান্তি আজ হানল এ কী দহনজ্বালা।
বিঁধল হৃদয় নিদয় বাণে বেদনঢালা॥
বক্ষে জ্বালায় অগ্নিশিখা, চক্ষে কাঁপায় মরীচিকা–
মরণসুতোয় গাঁথল কে মোর বরণমালা॥
চেনা ভুবন হারিয়ে গেল স্বপনছায়াতে
ফাগুনদিনের পলাশরঙের রঙিন মায়াতে।
যাত্রা আমার নিরুদ্দেশা, পথ হারানোর লাগল নেশা–
অচিন দেশে এবার আমার যাবার পালা॥
আকাশে আজ কোন্ চরণের আসা-যাওয়া
আকাশে আজ কোন্ চরণের আসা-যাওয়া
বাতাসে আজ কোন্ পরশের লাগে হাওয়া ॥
অনেক দিনের বিদায়বেলায় ব্যাকুল বাণী
আজ উদাসীর বাঁশির সুরে কে দেয় আনি–
বনের ছায়ায় তরুণ চোখের করুণ চাওয়া ॥
কোন্ ফাগুনে যে ফুল ফোটা হল সারা
মৌমাছিদের পাখায় পাখায় কাঁদে তারা।
বকুলতলায় কাজ-ভোলা সেই কোন্ দুপুরে
যে-সব কথা ভাসিয়ে দিলেম গানের সুরে
ব্যথায় ভ’রে ফিরে আসে সে গান-গাওয়া