- বইয়ের নামঃ স্মরণ
- লেখকের নামঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
- প্রকাশনাঃ বিশ্বভারতী (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
আজি প্রভাতেও শ্রান্ত নয়নে
আজি প্রভাতেও শ্রান্ত নয়নে
রয়েছে কাতর ঘোর ।
দুখশয্যায় করি জাগরণ
রজনী হয়েছে ভোর ।
নবফুটন্ত ফুলকাননের
নব জাগ্রত শীতপবনে
সাথি হইবারে পারে নি আজিও
এ দেহ – হৃদয় মোর ।
আজি মোর কাছে প্রভাত তোমার
করো গো আড়াল করো —
এ খেলা এ মেলা এ আলো এ গীত
আজি হেথা হতে হরো ।
প্রভাত জগৎ হতে মোরে ছিঁড়ি
করুণ আঁধারে লহো মোরে ঘিরি ,
উদাস হিয়ারে তুলিয়া বাঁধুক
তব স্নেহবাহুডোর ।
আজিকে তুমি ঘুমাও, আমি জাগিয়া রব দুয়ারে
আজিকে তুমি ঘুমাও, আমি জাগিয়া রব দুয়ারে–
রাখিব জ্বালি আলো।
তুমি তো ভালো বেসেছ, আজি একাকী শুধু আমারে
বাসিতে হবে ভালো।
আমার লাগি তোমারে আর হবে না কভু সাজিতে,
তোমার লাগি আমি
এখন হতে হৃদয়খানি সাজায়ে ফুলরাজিতে
রাখিব দিনযামী।
তোমার বাহু কত-না দিন শ্রান্তি-দুখ ভুলিয়া
গিয়েছে সেবা করি,
আজিকে তারে সকল তার কর্ম হতে তুলিয়া
রাখিব শিরে ধরি।
এবার তুমি তোমার পূজা সাঙ্গ করি চলিলে
সঁপিয়া মনপ্রাণ,
এখন হতে আমার পূজা লহো গো আঁখিসলিলে–
আমার স্তবগান।
শান্তিনিকেতন, ২৩ পৌষ, ১৩০৯
আপনার মাঝে আমি করি অনুভব
আপনার মাঝে আমি করি অনুভব
পূর্ণতর আজি আমি। তোমার গৌরব
মুহূর্তে মিশায়ে তুমি দিয়েছ আমাতে।
ছোঁয়ায়ে দিয়েছ তুমি আপনার হাতে
মৃত্যুর পরশমণি আমার জীবনে।
উঠেছ আমার শোকযজ্ঞহুতাশনে
নবীন নির্মল মূর্তি; আজি তুমি, সতী,
ধরিয়াছ অনিন্দিত সতীত্বের জ্যোতি,
নাহি তাহে শোকদাহ, নাহি মলিনিমা–
ক্লান্তিহীন কল্যাণের বহিয়া মহিমা
নিঃশেষে মিশিয়া গেছ মোর চিত্ত-সনে।
তাই আজি অনুভব করি সর্বমনে–
মোর পুরুষের প্রাণ গিয়েছে বিস্তারি
নিত্য তাহে মিলি গিয়া মৃত্যুহীন নারী।
শান্তিনিকেতন, ৪ পৌষ, ১৩০৯
আমার ঘরেতে আর নাই সে যে নাই
আমার ঘরেতে আর নাই সে যে নাই—
যাই আর ফিরে আসি, খুঁজিয়া না পাই।
আমার ঘরেতে নাথ, এইটুকু স্থান—
সেথা হতে যা হারায় মেলে না সন্ধান।
অনন্ত তোমার গৃহ, বিশ্বময় ধাম,
হে নাথ, খুঁজিতে তারে সেথা আসিলাম।
দাঁড়ালেম তব সন্ধ্যা-গগনের তলে,
চাহিলাম তোমা-পানে নয়নের জলে।
কোনো মুখ, কোনো সুখ, আশাতৃষা কোনো
যেথা হতে হারাইতে পারে না কখনো,
সেথায় এনেছি মোর পীড়িত এ হিয়া—
দাও তারে, দাও তারে, দাও ডুবাইয়া।
ঘরে মোর নাহি আর যে অমৃতরস
বিশ্ব-মাঝে পাই সেই হারানো পরশ।
এ সংসারে একদিন নববধূবেশে
এ সংসারে একদিন নববধূবেশে
তুমি যে আমার পাশে দাঁড়াইলে এসে,
রাখিলে আমার হাতে কম্পমান হাত,
সে কি অদৃষ্টের খেলা, সে কি অকস্মাৎ?
শুধু এক মুহূর্তের এ নহে ঘটনা,
অনাদিকালের এ আছিল মন্ত্রণা।
দোঁহার মিলনে মোরা পূর্ণ হব দোঁহে,
বহু যুগ আসিয়াছি এই আশা বহে।
নিয়ে গেছ কতখানি মোর প্রাণ হতে,
দিয়ে গেছ কতখানি এ জীবনস্রোতে!
কত দিন কত রাত্রে কত লজ্জাভয়ে
কত ক্ষতিলাভে কত জয়ে পরাজয়ে
রচিতেছিলাম যাহা মোরা শ্রান্তিহারা
সাঙ্গ কে করিবে তাহা মোরা দোঁহে ছাড়া?
শান্তিনিকেতন, ২ পৌষ, ১৩০৯
এসো, বসন্ত, এসো আজ তুমি
এসো, বসন্ত, এসো আজ তুমি
আমারও দুয়ারে এসো।
ফুল তোলা নাই, ভাঙা আয়োজন,
নিবে গেছে দীপ, শূন্য আসন,
আমার ঘরের শ্রীহীন মলিন
দীনতা দেখিয়া হেসো।
তবু, বসন্ত, তবু আজ তুমি
আমারও দুয়ারে এসো।
আজিকে আমার সব বাতায়ন
রয়েছে, রয়েছে খোলা।
বাধাহীন দিন পড়ে আছে আজ,
নাই কোনো আশা, নাই কোনো কাজ,
আপনা-আপনি দক্ষিণবায়ে
দুলিছে চিত্তদোলা,
শূন্য ঘরে সব বাতায়ন
আজিকে রয়েছে খোলা।
কত দিবসের হাসি ও কান্না
হেথা হয়ে গেছে সারা।
ছাড়া পাক তারা তোমার আকাশে,
নিশ্বাস পাক তোমার বাতাসে,
নব নব রূপে লভুক জন্ম
বকুলে চাঁপায় তারা।
গত দিবসের হাসি ও কান্না
যত হয়ে গেছে সারা।
আমার বক্ষে বেদনার মাঝে
করো তব উৎসব।
আনো তব হাসি, আনো তব বাঁশি,
ফুলপল্লব আনো রাশি রাশি,
ফিরিয়া ফিরিয়া গান গেয়ে যাক
যত পাখি আছে সব।
বেদনা আমার ধ্বনিত করিয়া
করো তব উৎসব।
সেই কলরবে অন্তর-মাঝে
পাব, পাব আমি সাড়া।
দ্যুলোকে ভূলোকে বাঁধি এক দল
তোমরা করিবে যবে কোলাহল,
হাসিতে হাসিতে মরণের দ্বারে
বারে বারে দিবে নাড়া
সেই কলরবে অন্তর-মাঝে
পাব, পাব আমি সাড়া।
শান্তিনিকেতন, ২৮ পৌষ, ১৩০৯
গোধূলি নিঃশব্দে আসি আপন অঞ্চলে ঢাকে যথা
গোধূলি নিঃশব্দে আসি আপন অঞ্চলে ঢাকে যথা
কর্মক্লান্ত সংসারের যত ক্ষত, যত মলিনতা,
ভগ্নভবনের দৈন্য, ছিন্নবসনের লজ্জা যত–
তব লাগি স্তব্ধ শোক স্নিগ্ধ দুই হাতে সেইমতো
প্রসারিত করে দিক অবারিত উদার তিমির
আমার এ জীবনের বহু ক্ষুব্ধ দিনযামিনীর
স্খলন খণ্ডতা ক্ষতি ভগ্নদীর্ণ জীর্ণতার ‘পরে-
সব ভালো-মন্দ নিয়ে মোর প্রাণ দিক এক ক’রে
বিষাদের একখানি স্বর্ণময় বিশাল বেষ্টনে।
আজ কোনো আকাঙক্ষার কোনো ক্ষোভ নাহি থাক মনে,
অতীত অতৃপ্তি-পানে যেন নাহি চাই ফিরে ফিরে–
যাহা-কিছু গেছে যাক, আমি চলে যাই ধীরে ধীরে
তোমার মিলনদীপ অকম্পিত যেথায় বিরাজে
ত্রিভুবনদেবতার ক্লান্তিহীন আনন্দের মাঝে।
শান্তিনিকেতন, ৩ জানুয়ারি, ১৯০৩