- বইয়ের নামঃ নৈবেদ্য
- লেখকের নামঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
- প্রকাশনাঃ বিশ্বভারতী (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
অচিন্ত্য এ ব্রহ্মান্ডের লোকলোকান্তরে
অচিন্ত্য এ ব্রহ্মান্ডের লোকলোকান্তরে
অনন্ত শাসন যাঁর চিরকালতরে
প্রত্যেক অণুর মাঝে হতেছে প্রকাশ,
যুগে যুগে মানবের মহা ইতিহাস
বহিয়া চলেছে সদা ধরণীর ‘পর
যাঁর তর্জনীর ছায়া, সেই মহেশ্বর
আমার চৈতন্যমাঝে প্রত্যেক পলকে
করিছেন অধিষ্ঠান; তাঁহারি আলোকে
চক্ষু মোর দৃষ্টিদীপ্ত, তাঁহারি পরশে
অঙ্গ মোর স্পর্শময় প্রাণের হরষে।
যেথা চলি, যেথা রহি, যেথা বাস করি
প্রত্যেক নিশ্বাসে মোর এই কথা স্মরি
আপন-মস্তক-‘পরে সর্বদা সর্বথা
বহিব তাঁহার গর্ব, নিজের নম্রতা।
অন্তরের সে সম্পদ ফেলেছি হারায়ে
অন্তরের সে সম্পদ ফেলেছি হারায়ে।
তাই মোরা লজ্জানত; তাই সর্ব গায়ে
ক্ষুধার্ত দুর্ভর দৈন্য করিছে দংশন;
তাই আজি ব্রাহ্মণের বিরল বসন
সম্মান বহে না আর; নাহি ধ্যানবল,
শুধু জপমাত্র আছে; শুচিত্ব কেবল
চিত্তহীন অর্থহীন অভ্যস্ত আচার।
সন্তোষের অন্তরেতে বীর্য নাহি আর,
কেবল জড়ত্বপুঞ্জ;ধর্ম প্রাণহীন
ভারসম চেপে আছে আড়ষ্ট কঠিন।
তাই আজি দলে দলে চাই ছুটিবারে
পশ্চিমের পরিত্যক্ত বস্ত্র লুটিবারে
লুকাতে প্রাচীন দৈন্য। বৃথা চেষ্টা ভাই,
সব সজ্জা লজ্জা-ভরা চিত্ত যেথা নাই।
অন্ধকার গর্তে থাকে অন্ধ সরীসৃপ
অন্ধকার গর্তে থাকে অন্ধ সরীসৃপ;
আপনার ললাটের রতনপ্রদীপ
নাহি জানে, নাহি জানে সূর্যালোকলেশ।
তেমনি আঁধারে আছে এই অন্ধ দেশ
হে দণ্ডবিধাতা রাজা– যে দীপ্ত রতন
পরায়ে দিয়েছ ভালে তাহার যতন
নাহি জানে, নাহি জানে তোমার আলোক।
নিত্য বহে আপনার অস্তিত্বের শোক,
জনমের গ্লানি। তব আদর্শ মহান
আপনার পরিমাপে করি খান-খান
রেখেছে ধূলিতে। প্রভু, হেরিতে তোমায়
তুলিতে হয় না মাথা ঊর্ধ্বপানে হায়।
যে এক তরণী লক্ষ লোকের নির্ভর
খণ্ড খণ্ড করি তারে তরিবে সাগর?
অমল কমল সহজে জলের কোলে
অমল কমল সহজে জলের কোলে
আনন্দে রহে ফুটিয়া–
ফিরিতে না হয় আলয় কোথায় ব’লে
ধুলায় ধুলায় লুটিয়া।
তেমনি সহজে আনন্দে হরষিত
তোমার মাঝারে রব নিমগ্নচিত,
পূজাশতদল আপনি সে বিকশিত
সব সংশয় টুটিয়া।
কোথা আছ তুমি পথ না খুঁজিব কভু,
শুধাব না কোনো পথিকে।
তোমারি মাঝারে ভ্রমিব ফিরিব, প্রভু,
যখন ফিরিব যে দিকে।
চলিব যখন তোমার আকাশগেহে
তব আনন্দপ্রবাহ লাগিবে দেহে,
তোমার পবন সখার মতন স্নেহে
বক্ষে আসিবে ছুটিয়া।
অল্প লইয়া থাকি তাই মোর
অল্প লইয়া থাকি, তাই মোর
যাহা যায় তাহা যায়–
কণাটুকু যদি হারায় তা লয়ে
প্রাণ করে হায়-হায়।
নদীতটসম কেবলি বৃথাই
প্রবাহ আঁকড়ি রাখিবারে চাই,
একে একে বুকে আঘাত করিয়া
ঢেউগুলি কোথা ধায়।
অল্প লইয়া থাকি,তাই মোর
যাহা যায় তাহা যায়।
যাহা যায় আর যাহা-কিছু থাকে
সব যদি দিই সঁপিয়া তোমাকে
তবে নাহি ক্ষয়, সবি জেগে রয়
তব মহা মহিমায়।
তোমাতে রয়েছে কত শশী ভানু,
কভু না হারায়ে অণু পরমাণু–
আমার ক্ষুদ্র হারাধনগুলি
রবে না কি তব পায়?
অল্প লইয়া থাকি,তাই মোর
যাহা যায় তাহা যায়।
আঁধার আসিতে রজনীর দীপ
আঁধার আসিতে রজনীর দীপ
জ্বেলেছিনু যতগুলি
নিবাও রে মন, আজি সে নিবাও
সকল দুয়ার খুলি।
আজি মোর ঘরে জানি না কখন
প্রভাত করেছে রবির কিরণ,
মাটির প্রদীপে নাই প্রয়োজন–
ধুলায় হোক সে ধূলি।
নিবাও, রে মন, রজনীর দীপ
সকল দুয়ার খুলি।
রাখো রাখো, আজ তুলিয়ো না সুর
ছিন্ন বীণার তারে।
নীরবে, রে মন,দাঁড়াও আসিয়া
আপন বাহির-দ্বারে।
শুন আজি প্রাতে সকল আকাশ
সকল আলোক সকল বাতাস
তোমার হইয়া গাহে সংগীত
বিরাট কণ্ঠ তুলি।
নিবাও নিবাও রজনীর দীপ
সকল দুয়ার খুলি।
আঁধারে আবৃত ঘন সংশয়
আঁধারে আবৃত ঘন সংশয়
বিশ্ব করিছে গ্রাস,
তারি মাঝখানে সংশয়াতীত
প্রত্যয় করে বাস।
বাক্যের ঝড় তর্কের ধূলি
অন্ধবুদ্ধি ফিরিছে আকুলি;
প্রত্যয় আছে আপনার মাঝে–
নাহি তার কোনো ত্রাস।
সংসারপথে শত সংকট
ঘুরিছে ঘূর্ণবায়ে,
তারি মাঝখানে অচলা শান্তি
অমরতরুচ্ছায়ে।
নিন্দা ও ক্ষতি মৃত্যু বিরহ
কত বিষবাণ উড়ে অহরহ,
স্থির যোগাসনে চির আনন্দ–
তাহার নাহিকো নাশ।
আঘাতসংঘাত-মাঝে দাঁড়াইনু আসি
আঘাতসংঘাত-মাঝে দাঁড়াইনু আসি।
অঙ্গদ কুণ্ডল কণ্ঠী অলংকাররাশি
খুলিয়া ফেলেছি দূরে। দাও হস্তে তুলি
নিজহাতে তোমার অমোঘ শরগুলি,
তোমার অক্ষয় তূণ। অস্ত্রে দীক্ষা দেহো
রণগুরু। তোমার প্রবল পিতৃস্নেহ
ধ্বনিয়া উঠুক আজি কঠিন আদেশে।
করো মোরে সম্মানিত নববীরবেশে,
দুরূহ কর্তব্যভারে, দুঃসহ কঠোর
বেদনায়; পরাইয়া দাও অঙ্গে মোর
ক্ষতচিহ্ন-অলংকার। ধন্য করো দাসে
সফল চেষ্টায় আর নিষ্ফল প্রয়াসে।
ভাবের ললিত ক্রোড়ে না রাখি নিলীন
কর্মক্ষেত্রে করি দাও সক্ষম স্বাধীন।
আজি হেমন্তের শান্তি ব্যাপ্ত চরাচরে
আজি হেমন্তের শান্তি ব্যাপ্ত চরাচরে।
জনশূন্য ক্ষেত্র-মাঝে দীপ্ত দ্বিপ্রহরে
শব্দহীন গতিহীন স্তব্ধতা উদার
রয়েছে পড়িয়া শ্রান্ত দিগন্তপ্রসার
স্বর্ণশ্যাম ডানা মেলি। ক্ষীণ নদীরেখা
নাহি করে গান আজি, নাহি লেখে লেখা
বালুকার তটে। দূরে দূরে পল্লী যত
মুদ্রিতনয়নে রৌদ্র পোহাইতে রত
নিদ্রায় অলস ক্লান্ত।
এই স্তব্ধতায়
শুনিতেছি তৃণে তৃণে ধুলায় ধুলায়,
মোর অঙ্গে রোমে রোমে,লোকে লোকান্তরে
গ্রহে সূর্যে তারকায় নিত্যকাল ধ’রে
অণুপরমাণুদের নৃত্যকলরোল–
তোমার আসন ঘেরি অনন্ত কল্লোল।