- বইয়ের নামঃ নদী
- লেখকের নামঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
নদী
ওরে তোরা কি জানিস কেউ
জলে কেন ওঠে এত ঢেউ ।
ওরা দিবস – রজনী নাচে ,
তাহা শিখেছে কাহার কাছে ।
শোন্ চলচল্ ছলছল্
সদাই গাহিয়া চলেছে জল ।
ওরা কারে ডাকে বাহু তুলে ,
ওরা কার কোলে ব’সে দুলে ।
সদা হেসে করে লুটোপুটি ,
চলে কোন্খানে ছুটোছুটি ।
ওরা সকলের মন তুষি
আছে আপনার মনে খুশি ।
আমি বসে বসে তাই ভাবি ,
নদী কোথা হতে এল নাবি ।
কোথায় পাহাড় সে কোন্খানে ,
তাহার নাম কি কেহই জানে ।
কেহ যেতে পারে তার কাছে ,
সেথায় মানুষ কি কেউ আছে ।
সেথা নাহি তরু নাহি ঘাস ,
নাহি পশুপাখিদের বাস ,
সেথা শবদ কিছু না শুনি ,
পাহাড় বসে আছে মহামুনি ।
তাহার মাথার উপরে শুধু
সাদা বরফ করিছে ধু ধু ।
সেথা রাশি রাশি মেঘ যত
থাকে ঘরের ছেলের মতো ।
শুধু হিমের মতন হাওয়া
সেথায় করে সদা আসা – যাওয়া ,
শুধু সারা রাত তারাগুলি
তারে চেয়ে দেখে আঁখি খুলি ।
শুধু ভোরের কিরণ এসে
তারে মুকুট পরায় হেসে ।
সেই নীল আকাশের পায়ে
সেথা কোমল মেঘের গায়ে
সেথা সাদা বরফের বুকে
নদী ঘুমায় স্বপনসুখে ।
কবে মুখে তার রোদ লেগে
নদী আপনি উঠিল জেগে ,
কবে একদা রোদের বেলা
তাহার মনে পড়ে গেল খেলা ।
সেখায় একা ছিল দিনরাতি ,
কেহই ছিল না খেলার সাথি ।
সেথায় কথা নাহি কারো ঘরে ,
সেথায় গান কেহ নাহি করে ।
তাই ঝুরু ঝুরু ঝিরি ঝিরি ।
নদী বাহিরিল ধীরি ধীরি ।
মনে ভাবিল , যা আছে ভবে
সবই দেখিয়া লইতে হবে ।
নীচে পাহাড়ের বুক জুড়ে
গাছ উঠেছে আকাশ ফুঁড়ে ।
তারা বুড়ো বুড়ো তরু যত
তাদের বয়স কে জানে কত ।
তাদের খোপে খোপে গাঁঠে গাঁঠে
পাখি বাসা বাঁধে কুটো – কাঠে ।
তারা ডাল তুলে কালো কালো
আড়াল করেছে রবির আলো ।
তাদের শাখায় জটার মতো
ঝুলে পড়েছে শেওলা যত ।
তারা মিলায়ে মিলায়ে কাঁধ
যেন পেতেছে আঁধার – ফাঁদ ।
তাদের তলে তলে নিরিবিলি
নদী হেসে চলে খিলিখিলি ।
তারে কে পারে রাখিতে ধরে ,
সে যে ছুটোছুটি যায় সরে ।
সে যে সদা খেলে লুকোচুরি ,
তাহার পায়ে পায়ে বাজে নুড়ি ।
পথে শিলা আছে রাশি রাশি ,
তাহা ঠেলে চলে হাসি হাসি ।
পাহাড় যদি থাকে পথ জুড়ে
নদী হেসে যায় বেঁকেচুরে ।
সেথায় বাস করে শিং – তোলা
যত বুনো ছাগ দাড়ি – ঝোলা ।
সেথায় হরিণ রোঁয়ায় ভরা
তারা কারেও দেয় না ধরা ।
সেথায় মানুষ নূতনতর ,
তাদের শরীর কঠিন বড়ো ।
তাদের চোখ দুটো নয় সোজা ,
তাদের কথা নাহি যায় বোঝা ।
তারা পাহাড়ের ছেলেমেয়ে
সদাই কাজ করে গান গেয়ে ।
তারা সারা দিনমান খেটে
আনে বোঝাভরা কাঠ কেটে ।
তারা চড়িয়া শিখর -‘ পরে
বনের হরিণ শিকার করে ।
নদী যত আগে আগে চলে
ততই সাথি জোটে দলে দলে ।
তারা তারি মতো , ঘর হতে
সবাই বাহির হয়েছে পথে ।
পায়ে ঠুনু ঠুনু বাজে নুড়ি ,
যেন বাজিতেছে মল চুড়ি ।
গায়ে আলো করে ঝিকিঝিক ,
যেন পরেছে হীরার চিক ।
মুখে কলকল কত ভাষে
এত কথা কোথা হতে আসে ।
শেষে সখীতে সখীতে মেলি
হেসে গায়ে গায়ে হেলাহেলি ।
শেষে কোলাকুলি কলরবে
তারা এক হয়ে যায় সবে ।
তখন কলকল ছুটে জল —
কাঁপে টলমল ধরাতল ,
কোথাও নীচে পড়ে ঝরঝর —
পাথর কেঁপে ওঠে থরথর ,
শিলা খান্ খান্ যায় টুটে —
নদী চলে পথ কেটে কুটে ।
ধারে গাছগুলো বড়ো বড়ো
তারা হয়ে পড়ে পড়ো – পড়ো ।
কত বড়ো পাথরের চাপ
জলে খসে পড়ে ঝুপঝাপ ।
তখন মাটি – গোলা ঘোলা জলে
ফেনা ভেসে যায় দলে দলে ।
জলে পাক ঘুরে ঘুরে ওঠে ,
যেন পাগলের মতো ছোটে ।
শেষে পাহাড় ছাড়িয়ে এসে
নদী পড়ে বাহিরের দেশে ।
হেথা যেখানে চাহিয়া দেখে
চোখে সকলি নূতন ঠেকে ।
হেথা চারি দিকে খোলা মাঠ ,
হেথা সমতল পথঘাট ।
কোথাও চাষিরা করিছে চাষ ,
কোথাও গোরুতে খেতেছে ঘাস ।
কোথাও বৃহৎ অশথ গাছে
পাখি শিস দিয়ে দিয়ে নাচে ।
কোথাও রাখাল ছেলের দলে
খেলা করিছে গাছের তলে ।
কোথাও নিকটে গ্রামের মাঝে
লোকে ফিরিছে নানান কাজে ।
কোথাও বাধা কিছু নাহি পথে ,
নদী চলেছে আপন মতে ।
পথে বরষার জলধারা
আসে চারি দিক হতে তারা ,
নদী দেখিতে দেখিতে বাড়ে ,
এখন কে রাখে ধরিয়া তারে ।
তাহার দুই কূলে উঠে ঘাস ,
সেথায় যতেক বকের বাস ।
সেথা মহিষের দল থাকে ,
তারা লুটায় নদীর পাঁকে ।
যত বুনো বরা সেথা ফেরে
তারা দাঁত দিয়ে মাটি চেরে ।
সেথা শেয়াল লুকায়ে থাকে ,
রাতে হুয়া হুয়া করে ডাকে ।
দেখে এইমতো কত দেশ ,
কে বা গনিয়া করিবে শেষ ।
কোথাও কেবল বালির ডাঙা ,
কোথাও মাটিগুলো রাঙা রাঙা ,
কোথাও ধারে ধারে উঠে বেত ,
কোথাও দুধারে গমের খেত ।
কোথাও ছোটোখাটো গ্রামখানি ,
কোথাও মাথা তোলে রাজধানী —
সেথায় নবাবের বড়ো কোঠা ,
তারি পাথরের থাম মোটা ।
তারি ঘাটের সোপান যত ,
জলে নামিয়াছে শত শত ।
কোথাও সাদা পাথরের পুলে
নদী বাঁধিয়াছে দুই কূলে ।
কোথাও লোহার সাঁকোয় গাড়ি
চলে ধকো ধকো ডাক ছাড়ি ।
নদী এইমতো অবশেষে
এল নরম মাটির দেশে ।
হেথা যেথায় মোদের বাড়ি
নদী আসিল দুয়ারে তারি ।
হেথায় নদী নালা বিল খালে
দেশ ঘিরেছে জলের জালে ।
কত মেয়েরা নাহিছে ঘাটে ,
কত ছেলেরা সাঁতার কাটে ;
কত জেলেরা ফেলিছে জাল ,
কত মাঝিরা ধরেছে হাল ,
সুখে সারিগান গায় দাঁড়ি ,
কত খেয়া – তরী দেয় পাড়ি ।