- বইয়ের নামঃ প্রথম প্রহর
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- প্রকাশনাঃ অন্যপ্রকাশ
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস, কল্পকাহিনী
আমার বয়স প্রায় বত্রিশ
আমার বয়স প্রায় বত্রিশ।
প্রায় বললাম এই জন্যে যে মাসের হিসেবে একটু গণ্ডগোল আছে। আমার বাবার খাতাপত্রে আছে আমার জন্ম ডিসেম্বর মাসের তিন তারিখ। আমার মা নিজেও বলেন ডিসেম্বর। মা-বাবার কথাই এসব ক্ষেত্রে সঠিক বলে ধরে নেওয়া হয়। কিন্তু আমার যেখানে জন্ম, সেই নানার বাড়িতে সবাই জানে আমার জন্ম হয়েছে জানুয়ারির তিন তারিখে। পুরো একটা মাসের গণ্ডগোল।
আমার মায়ের কথায় আমি বিশেষ গুরুত্ব দিই না। কারণ তিনি আমার বাবার সব কথাকেই অভ্ৰান্ত মনে করেন। বাবা যদি বলেন–না-না, ফরিদের জন্ম এপ্রিল মাসে। ডিসেম্বরে কে বলল? তাহলে প্রথম কিছু দিন মা কিছুই বলবেন না। তারপর বলবেন-হা তাই তো, ওর জন্মের সময় তো গরমই ছিল। জানালা রাতে খোলা থাকত, স্পষ্ট মনে আছে।
এক মাসের তফাৎ এমন কিছু নয়। আমি অতি নগণ্য ব্যক্তি। পৃথিবীর অনেক। বিখ্যাত মানুষেরই জন্মের দিন-তারিখে গণ্ডগোল আছে। তবু কয়েক দিন ধরে মনে হচ্ছে এক মাস খুব কমও নয়। আমার আয়ু যদি বত্রিশ বছর হয়, তাহলে এক মাস হচ্ছে আমার মোট জীবনের তিন শ চুরাশি ভাগের এক ভাগ। অনেকটা সময়। তিরিশ দিন মানে হচ্ছে সাত শ বিশ ঘন্টা। আরো হোট করে বললে পঁচিশ লক্ষ সেকেণ্ডেরও কিছু বেশি। খুব একটা হেলাফেলা করার মতো ব্যাপার নয়।
গত পনের দিন ধরেই এই সব তুচ্ছ বিষয় নিয়ে আমি ভাবছি, তুচ্ছ বলাটা বোধহয় ঠিক হচ্ছে না। কারণ গত পনের দিন ধরেই আমি হাসপাতালে ভর্তি হবার চেষ্টা করছি। ভর্তি হতে পারলেই তলপেটের ড়ুওডেনালের মুখে একটা অপারেশন হবে। কবুতরের ডিমের মতো একটা টিউমার ডাক্তাররা সরিয়ে ফেলতে চেষ্টা করবেন।
টিউমারটি ম্যালিগনেন্ট কিনা, তা আমাকে কেউ বলছে না। ডাক্তার কাঁধ ঝাঁকুনি দিয়ে শুধু বলছেন, আরে, এই সব নিয়ে আপনার এত চিন্তা কিসের? হাসপাতালে আগে ভর্তি হয়ে যান, তারপর দেখা যাবে। ডাক্তারের কাঁধ-ঝাঁকুনিটা আমার ভালো লাগে নি। যেন খুব চেষ্টা করে ঝাকান। এর চেয়েও সন্দেহজনক। হচ্ছে, দ্বিতীয় বার যখন এক্স-রে রিপোর্ট নিয়ে তার কাছে গেলাম এবং ভিজিট দিতে গেলাম, তিনি অমায়িক ভঙ্গিতে হেসে বললেন, আরে, এক বার তো ভিজিট দিয়েছেন, আবার কেন?
ভিজিট নেয়ার ব্যাপারে কোনো ডাক্তার আপত্তি করেন বলে জানতাম না। ইনি এই বাড়তি দয়াটি কেন দেখাচ্ছেন? কেন এই অনুগ্ৰহ?
আপনি একটা সীট যোগাড় করেন। দি আরলিয়ার দি বেটার।
চেষ্টা তো করছি, পারছি না তো।
রোজ যাবেন। রোজ খোঁজ নেবেন।
আমি রোজ যাই। হেঁটে যাই। রিকশা করে ফিরি। ঘন্টাখানিক সময় কাটে হাসপাতালে। খুব যে খারাপ কাটে তা নয়। এ্যাডমিশন সেকশনের বেশ কয়েক জনের সঙ্গে আমার খাতির হয়েছে। এক জন হচ্ছে মতি ভাই। অসম্ভব রোগা মানুষ। সাধারণত রোগা মানুষেরা লম্বা হয়–মতি ভাই বেঁটে। তাঁর কাছে বসলেই তিনি নিছু গলায় অনবরত কথা বলেন। বিরক্তিতে কপাল কোঁচকান এবং কিছুক্ষণ পরপর দেয়াশলাইয়ের কাঠি দিয়ে দাঁত খোচান। আমাকে দেখলেই চায়ের অর্ডার দিয়ে গলা নিচু করে বলেন, হবে হবে, ধৈর্য ধরেন।
আমি ধৈর্য ধরি। খানিকক্ষণ তার সঙ্গে গল্পগুজব করে ঘরে ফিরে এক মাসের হিসেব করি।
এক মাস হচ্ছে সাত শ বিশ ঘন্টা। তেতাল্লিশ হাজার দু শ মিনিট। পঁচিশ লক্ষ বিরানই হাজার সেকেণ্ড দীর্ঘ সময়।
একটা কেবিন যোগাড় করে
আমার বন্ধুরা শেষ পর্যন্ত একটা কেবিন যোগাড় করে ফেলল। কেবিন নাম্বার দু শ এগারো। বন্ধুবান্ধবরা যোগাড় করল বলাটা বোধ হয় ঠিক হচ্ছে না, করল মনসুর। বিয়ে করার পর তার কিছুনতুন যোগাযোগ হয়েছে। তার শত্রবাড়ির লোকজন, যে কোনো কারণেই হোক, বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ মানুষদের চেনে। মনসুরের বিয়েতে এক জন মেজর জেনারেল পর্যন্ত এসেছিলেন। মেজর জেনারেলদের চেহারা এমন সাধারণ হয় আমার জানা ছিল না। এরাও পাঞ্জাবি গায়ে দিয়ে বিয়ে খেতে আসে এবং রোস্টের টুকরো বদলে দিতে বলে দেখে আমি যথেষ্ট অবাক হয়েছিলাম। মনসুরের শ্বশুর তাকে তুই তুই করে বলেছিলেন, সেও এক বিস্ময়।
আমার সীট যোগাড় করার ব্যাপারে এই ভদ্রলোকের হাত আছে বলে আমার ধারণা। মনসুর অবশ্য ভেঙে কিছু বলল না। শুধুবলল–খুব ভালো ঘর। দিন-রাত হাওয়া খেলে। ভাবটা এরকম–যেন হোটেলের ঘর পছন্দ করছি। হাওয়া খেললে নেব, নয়তো নেব না। আমি বললাম, কবে যেতে হবে?
সোমবারে। সোমবারে খালি হবে। যে আছে সে রিলিজ হয়ে যাবে।
জন্মের রিলিজ নাকি?
আরে না। অসুখ সেরে গেছে। এখন পেশেন্ট বাড়ি যাচ্ছে।
বলেই মনসুর গলা টেনে-টেনে অনেকক্ষণ ধরে হাসল–র মানে হচ্ছে পেশেন্টের বাড়ি যাওয়ার ব্যাপারটা ঠিক নয়। পুরোপুরিই রিলিজড হয়ে অন্য কোথাও যাবে। মনসুর বলল, তুই প্রিপারেশন নিয়ে নেয়।
কী প্রিপারেশন নেব?
কাপড়টাপড় গুছিয়ে ফেল। থার্মোফ্ল্যাক্স আছে? নেই–না? একটা থামোফ্লাস্ক দরকার।
থার্মোয়াঙ্ক দিয়ে কী হবে? চাটা খাবি। বললেই এনে দেবে।
মনসুর খুব উৎসাহ দেখাতে লাগল। হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার ব্যাপারটায় সে একটা উৎসব নিয়ে আসতে চেষ্টা করছে। যেন খুব ফুর্তির ব্যাপার।
বড়ো সুটকেস আছে?
নাহ।
হ্যাণ্ডব্যাগ? হ্যাণ্ডব্যাগ তো আছে?