- বইয়ের নামঃ পোকা
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- প্রকাশনাঃ পার্ল পাবলিকেশন্স
- বিভাগসমূহঃ ভূতের গল্প, উপন্যাস, রহস্যময় গল্প
নামের শেষে অক্ষর
আলতাফ হোসেনের নামের শেষে অনেকগুলি অক্ষর।
আলতাফ হোসেন বি. এ. (অনার্স), এম, এ, বি, টি, এল, এল, বি.।
প্রতিটি অক্ষরের পেছনে কিছু ইতিহাস আছে। যেহেতু পোকার নায়ক আলতাফ হোসেন সেহেতু তার ইতিহাস জানা থাকলে পোকার বিষয়বস্তু বুঝতে সুবিধা হবে। অনার্স থেকে শুরু করা যাক। আলতাফের ইচ্ছা ছিল পাস কোর্সে পড়া। তার দূর সম্পর্কের মামা এ.জি, অফিসের সিনিয়র এসিসটেন্ট বজলুর রহমান বললেন, অনার্স পড়। শুনতে ভাল লাগে। আলতাফ হোসেন ক্ষীণ গলায় বলল, ইন্টারমিডিয়েটের রেজাল্ট খারাপ, অনার্সে ভর্তি হতে পারব না, মামা। বজলুর রহমান বললেন, চেষ্টা করে দেখ। কত আজে-বাজে সাবজেক্ট আছে–পল সায়েন্স, ফল সায়েন্স। আলতাফ অনেক খুঁজে পেতে জগন্নাথ কলেজে অনার্সে ভর্তি হয়ে গেল। বজলুর রহমান বললেন, খাটাখাটনি করে পড়। খাটাখাটনি কখনো বৃথা যায় না। কথায় আছে–খাটে মানুষ টে না।
আলতাফ প্রচণ্ড খাটাখাটনি করল। অনার্স পরীক্ষার রেজাল্ট বের হবার পর সে তার মামার পা ছুঁয়ে সালাম করল। ক্ষীণ গলায় বলল, রেজাল্ট হয়েছে মামা। বজলুর রহমান বিছানায় শুয়ে ছিলেন। তিনি উঠে বসলেন। উৎসাহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কি রেজাল্ট?
থার্ড ক্লাস পেয়েছি, মামা।
বলজুর রহমান সাহেবের উৎসাহ মরে গেল। তিনি হতাশ গলায় বললেন, এত পড়াশোনা করে শেষে থার্ড ক্লাস?
জি মামা।
থার্ড ক্লাস ডিগ্রী নিয়ে চাকরি-বাকরি তো কিছুই পাবি না। এখন করবি কি?
আপনি বলে দিন, মামা।
এম, এ, দিয়ে দে। এম, এ, পাশ থাকলে থার্ড ক্লাসের দোষ কাটা যায়। ভালমত পড়াশুনা করে এম. এ. দে। খাটাখাটনি কর। কথায় আছে–খাটে মানুষ ঘাঁটে না।
আলতাফ হোসেন খুব ভালমত পড়াশুনা করে এম, এ, দিল। রেজাল্ট বের হবার পর যথারীতি পা ছুঁয়ে মামাকে সালাম করল। বজলুর রহমান শংকিত গলায় বললেন, কি রে, এবারো থার্ড ক্লাস?
জ্বি মামা।
থার্ড ক্লাসের তুই তো দোকান দিয়ে ফেলেছিস রে গাধা।
আলতাফ হোসেন ক্ষীণ স্বরে কি যেন বলল, পরিষ্কার বোঝা গেল না। তার বেশিরভাগ কথাই পরিষ্কার বোঝা যায় না। তবে আর চোখ ভিজে উঠল। বজলুর রহমান বললেন, যা হবার হয়ে গেছে। এখন চাকরি-বাকরি খোঁজ। রোজগারপাতির চেষ্টা তো দেখা দরকার। আমার ঘাড়ে বসে কতদিন খাবি? আর থার্ড ক্লাস নিয়ে মন খারাপ করিস না। ডিগ্রীটাই সবাই দেখবে, ক্লাস কে দেখবে? এত সময় কার আছে? তাছাড়া থার্ড ক্লাস পাওয়াও সহজ না। এক চান্সে পেয়েছিস, এটা কম কথা না।
মামার উপদেশমত আলতাফ হোসেন চাকরির খোঁজে লেগে গেল। দু’বছর অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে চাকরি খুঁজল। কিছু হল না। বলজুর রহমান বললেন, বি, টি, দিয়ে ফেল। বি, টি, থাকলে স্কুলের চাকরি পেয়ে যাবি। স্কুলের চাকরিতেই আজকাল মজা। প্রাইভেট টিউশানি করবি, দুই হাতে টাকা কামাবি। স্কুল মাস্টারি আজকাল কেউ করতে চায় না, ঐ লাইনে চাকরি খালি আছে।
আলতাফ হোসেন বি. টি, পাশ করল। স্কুলের কোন চাকরি জোগাড় করা গেল না। স্কুলে সায়েন্স গ্রেজুয়েট চায়, এম, এ, বি, টি, চায় না। আরো দু বছর গেল। বজলুর রহমান বললেন, এল. এল. বি.টা দিয়ে দিবি নাকি? আইনের একটা ডিগ্রী থাকলে সুবিধা হবে। আলতাফ হোসেন এল, এল, বি, ডিগ্রী নিয়ে নিল। চাকরির কোন সুবিধা হল না।
বজলুর রহমান হতাশ হয়ে একদিন বললেন, বিয়ে করবি? অনেক সময় বিয়ে করলে ভাগ্য ফেরে। কথায় আছে–স্ত্রী ভাগ্যে ধন। দেখবি বিয়ে করে?
আলতাফ হোসেন অস্পষ্ট গলায় বলল, জ্বি আচ্ছা।
চাকরি পাওয়া না গেলেও বিয়ের মেয়ে পেতে অসুবিধা হল না। আট-দশটি মেয়ের সন্ধান পাওয়া গেল। এই মেয়েগুলির অভিভাবকদের কথা শুনলে মনে হতে পারে এরা বেকার ছেলেই খুঁজছিল। একজন তো বলেই ফেলল, পাত্র হিসেবে বেকার ছেলের তুলনা নেই। এরা খুব স্ত্রীভক্ত হয়ে থাকে। চাকরি বাকরি নেই তো, তাই স্ত্রীকে খুব মানে। আরে ভাই, চাকরি তো একসময় হবেই। রিজিক আল্লার হাতে। মানুষের হাতে থাকলে চিন্তার বিষয় ছিল।
বজলুর রহমান মেয়ে দেখে বেড়াতে লাগলেন। আষাঢ় মাসের ন’ অরিখে বিয়ের কথা পাকা করে এক কেজি বাসি সন্দেশহাতে বাসায় ফিরলেন। মেয়ের নাম হোসনে আরা। লালমাটিয়া কলেজে বি, এ, পড়ে। গায়ের রঙ ময়লা হলেও মাথাভর্তি চুল।
বজলুর রহমান রাতে খেতে বসে খুব আগ্রহের সাথে হোসনে আরার লম্বা চুলের গল্প করতে গিয়ে লক্ষ্য করলেন, তার স্ত্রী মনোয়ারা কোন রকম আগ্রহ দেখাচ্ছে না। শুধু তার মেয়ে দুলারী চোখ বড় বড় করে শুনছে। বজলুর রহমান তৃপ্ত গলায় বললেন, মেয়ের চুল ১.২২ মিটার লম্বা।
কেউ তেমন বিস্মিত হল না, শুধু দুলারী বলল, তুমি কি গজফিতা দিয়ে মেপেছ?
আমি মাপব কেন? ওরা নিয়মিত মাপে।
তাহলে তো আমাদেরও মাপতে হবে। তুমি একটা গজফিতা কিনে এনো তো বাবা।
তিনি বিরক্ত গলায় বললেন, তুই এমন বাঁকা কথা বলছিস কেন? কি হলো?
দুলারী বলল, এক মিটার সমান কত ফুট তুমি কি জান, বাবা?
না, জানি না।
তোমার উচিত ছিল ওদের জিজ্ঞেস করা। মিটারের হিসাব তো সবাই জানে না, গজ-ফুটের হিসাব জানে।