- বইয়ের নামঃ পেন্সিলে আঁকা পরী
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- প্রকাশনাঃ প্রতীক প্রকাশনা সংস্থা
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
পেন্সিলে আঁকা পরী
মোবারক সাহেবের গলার স্বর ভারি ও খসখসে।
কোমল করে কিছু বলতে গেলে স্বর আরো ভারি হয়ে যায়। তবু তিনি চেষ্টা করলেন কোমল করে কিছু বলতে। মেয়েটার সঙ্গে শুরুতে একটু ভাব করে নেয়া দরকার। অল্প বয়সী মেয়ে–গলা শুনেই যেন ঘাবড়ে না যায়। কী বলা যায়? নাম জিজ্ঞেস করা যেতে পারে। যে-কোনো কথোপকথন নাম জানার মাধ্যমে শুরু হতে পারে।
রাত এগারটা। মেয়েটি এবং তিনি বিছানায় পাশাপাশি শুয়ে আছেন। অথচ তিনি তার নাম জানেন না। বেশ মজার ব্যাপার। মেয়েটিও নিশ্চয়ই তার নাম জানে না। নাকি জানে? এ জাতীয় মেয়েরা তলে তলে খুব চালাক চতুর হয়। নামধাম সব জেনে নিয়েছে হয়তো।
মোবারক সাহেব হাসির মতো ভঙ্গি করে বললেন, তোমার নাম কী?
মেয়েটি রিনারিনে গলায় বলল, টেপী।
কী নাম বললে?
টেপী। ট-একারে টে, প ঈ-কারে পী–টেপী।
মোবারক সাহেব গভীর গলায় বললেন, ফাজলামি করছি নাকি?
ফাজলামি করব কেন? নাম জিজ্ঞেস করেছেন, নাম বললাম।
মেয়েটা হাসছে। ঝনঝনি শব্দে হাসছে। মোবারক সাহেব উঁচু গলায় বললেন, সত্যি তোমার নাম টেপী?
হুঁ। আমার বড় বোনের নাম হ্যাঁপী। তার সঙ্গে মিলিয়ে আমার নাম টেপী।
আবারো খিলখিল হাসি। মেয়েটার গলার ভেতর কি একগাদা কৃস্টালের টুকরা রেখে দেয়া? হাসলেই ঝন ঝন শব্দ। নাকি এই বয়সের মেয়েরা এ রকম করেই হাসে!
মোবারক সাহেবের ধারণা হলো, মেয়েটা তাঁর সঙ্গে ফাজলামি করছে। পুচকা একটা মেয়ে ফাজলামি করছে, ভাবাই যায় না। মেয়েটার বয়স কত? কুড়ি-একুশ, নাকি তারচেয়ে কম?
মেয়েটি ফাজলামি করছে কিনা নিশ্চিত হওয়া দরকার। কীভাবে নিশ্চিত হবেন। মোবারক সাহেব বুঝতে পারছেন না। হ্যাঁপীর সঙ্গে মিলিয়ে টেপী নাম কেউ রাখলে রাখতেও পারে। লো-ক্লাস ফ্যামিলিতে নাম নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। প্রথম বাচ্চাটার নাম ঠিকঠাক মতো রাখে; তারপর উৎসাহ হারিয়ে ফেলে।
তোমরা কি দুই বোন?
না, তিন বোন।
তৃতীয় বােনের নাম কী?
পেপী।
মোবারক সাহেব থমথমে গলায় বললেন, তৃতীয় বােনের নাম পেপী?
জ্বি। বোনদের নাম মিলিয়ে রাখতে হয়। নাম মিলিয়ে না রাখলে বেহেশতে বোনে বোনে দেখা হয় না।
তুমি পড়াশুনো কতদূর করেছ?
ক্লাস ফাইভ।
কথাবার্তা শুনে তো মনে হয় ক্লাস ফাইভের চেয়ে বেশি পড়েছ এবং আমার ধারণা তুমি আমার সঙ্গে রসিকতা করার চেষ্টা করছ।
আপনি মুরব্বি মানুষ। আপনার সঙ্গে রসিকতা করব কেন?
তিনি বাতি জ্বালালেন।
বাতি জ্বলামাত্র মেয়েটি চেঁচিয়ে উঠল, বাতি নেভান, বাতি নেভান। গায়ে কাপড় নাই। তিনি বাতি নিভিয়ে দিলেন। টেপী সঙ্গে সঙ্গে বলল, এখন জ্বলেন। কাপড় পরেছি।
তিনি বাতি জ্বালালেন না। হাত বাড়িয়ে টেবিল ল্যাম্পের কাছে রাখা সিগারেটের প্যাকেট থেকে সিগারেট নিলেন। লাইটার দিয়ে সিগারেট ধরালেন। লাইটারের আলোয় মেয়েটিকে দেখার ইচ্ছা করছিল, সেই ইচ্ছা দমন করলেন। তিনি সূক্ষ্ম এক ধরনের অস্বস্তি বোধ করছেন। মেয়েটির কোনো একটা ব্যাপার তার পছন্দ হচ্ছে না। সেটা যে কী তাও বুঝতে পারছেন না। মেয়েটির চুল থেকে কোনো রিপালসিভ গন্ধ কি আসছে? কিং শাড়ি থেকে ন্যাপথলিনের ঘাণ? এইসব মেয়েরা তাদের ভালো শাড়িগুলোর ভাঁজে ভাঁজে ন্যাপথলিন দিয়ে রাখে। যেন পোকায় কেটে শাড়ি নষ্ট না করে।
সিগারেট টেনে তিনি আরাম পাচ্ছেন না। তামাকের গন্ধটা অনেক কড়া লাগছে। বমি বমি লাগছে। সিগারেট ফেলে দিতে হবে। টেবিল ল্যাম্পের কাছে অ্যাশট্রে থাকে, আজ নেই। হাউসকিপিং ঠিকমতো হচ্ছে না। তিনি খাট থেকে নামলেন। টেপী সঙ্গে সঙ্গে বলল, কোথায় যান?
তিনি জবাব দিলেন না। অন্ধকারেই বাথরুমে ঢুকলেন। বাথরুমের বাতি জ্বালালেন। আয়নায় নিজেকে দেখলেন। যতটা না বয়স তারচেয়েও কি বেশি দেখাচ্ছে? তাঁর বয়স তিপ্লান্ন, আয়নায় একজন বুড়ো মানুষকে দেখা যাচ্ছে। তিনি জ্বলন্ত সিগারেট কমোডে ফেলে দিলেন। ফ্লাশ টানলেন। পানির সঙ্গে সিগারেট চলে গেল না। ভাসতে থাকল। মুখে পানি ছিটিয়ে টাওয়েল হাতে শোবার ঘরে ঢুকলেন। শোবার ঘরের প্রধান সুইচটি টিপে দিলেন। একসঙ্গে তিনটি বাতি জ্বলে ঘরটাকে ঝলমলে করে ফেলল।
মেয়েটি তাকে মিথ্যা বলেছে। সে কাপড় পরে নি। গলা পর্যন্ত চাদর টেনে শুয়ে আছে। কৌতুহলী চোখে তাকে দেখছে। মেয়েটা দেখতে ভালো। বয়সের নিজস্ব সৌন্দর্য ছাড়াও বাড়তি কিছু তার মধ্যে আছে। রং শ্যামলা। রং শ্যামলা বলেই চোখের কাজল এত সুন্দর লাগছে। কাটা কাটা নাক-মুখ। মেয়েটির চুল বেণি করা ছিল, এখন নেই। এক ফাঁকে নিশ্চয়ই খুলেছে। কখন খুলল?
টেপী বলল, আপনার কি শরীর খারাপ করেছে? তিনি জবাব দিলেন না, তবে প্রশ্নটা শোনার পর থেকে তাঁর শরীর একটু খারাপ লগতে লাগল। মাথা ঝিম ধরে আছে। বমি ভাবটা যায় নি। তিনি শোবার ঘরের জানালার দিকে এগুলেন–একটা জানোলা খুলে দিতে হবে। ঘরে বিশুদ্ধ কিছু বাতাস ঢুকুক। এয়ারকুলার চলছে বলে সব ক’টা জানালা বন্ধ। সিগারেটের ধোয়া ঘরে আটকে আছে। সিগারেটের ধোঁয়া যত বাসি হয় তার উৎকট ভাব ততই বাড়ে। জানালার পাশে তাঁর ফ্রিজার। শোবার ঘরে কেউ ফ্রিজার রাখে না। তিনি রেখেছেন। তাঁর খুব ঘনঘন পিপাসা হয়। তখন বরফশীতল পানি খেতে হয়। এই ফ্রিজারটা ভালো, পানি রাখামাত্র ঠাণ্ড হয়। জানালা না খুলে তিনি তাঁর ফ্রিজারের দরজা খুললেন।