- বইয়ের নামঃ দিঘির জলে কার ছায়া গো
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- প্রকাশনাঃ অন্যপ্রকাশ
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস, কল্পকাহিনী
বুধবার হলো মুহিবের মিথ্যাদিবস
উৎসর্গ
কন্যা লীলাবতীকে
এই উপন্যাসের নায়িকা লীলা। আমার মেয়ে লীলাবতীর নামে নাম। লীলাবতী কোনোদিন বড় হবে না। আমি কল্পনায় তাকে বড় করেছি। চেষ্টা করেছি ভালোবাসায় মাখামাখি একটি জীবন তাকে দিতে। মা লীলাবতী! নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে, রয়েছ নয়নে নয়নে।
———–
ভালোবাসা কী?
Theory of relativity has nothing to do with it.–আইনস্টাইন
Soft version of sexual attraction.–শোয়েডিঞ্জার (কোয়ান্টাম বিজ্ঞানের জনক)
ভালোবাসাই ঈশ্বর।–ম্যাথমেটিশিয়ান অ্যাবেল
————-
০১.
আজ বুধবার।
বুধবার হলো মুহিবের মিথ্যাদিবস। মিথ্যাদিসে রাত এগারোটা উনষাট মিনিট পর্যন্ত সে মিথ্যা কথা বলে। তার এই ব্যাপারটা একজন শুধু জানে। সেই একজনের নাম লীলা। লীলার বয়স একুশ। সে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়ে অনার্স সেকেন্ড ইয়ার। বিষয় ইংরেজি সাহিত্য।
লীলার সবই সুন্দর। চেহারা সুন্দর, চোখ সুন্দর, মাথার কোঁকড়ানো চুল সুন্দর। ক্লাসে তার একটা নিক নেম আছে— সমুচা। এমন রূপবতী একটা মেয়ের নাম সমুচা কেন সেটা একটা রহস্য। নাম নিয়ে লীলার কোনো সমস্যা নেই। সে বন্ধুদের টেলিফোন করে নির্বিকার ভঙ্গিতে বলে, আমি সমুচা বলছি।
মুহিবের বয়স ত্রিশ। গায়ের রঙ কালো। বেশ কালো কালো ছেলেদের ঝকঝকে সাদা দাঁত হয়। মুহিবের দাঁত ঝকঝকে সাদা। পেপসোডেন্ট টুথপেস্ট কোম্পানি একবার তাকে টুথপেস্টের বিজ্ঞাপনের জন্যে সিলেক্ট করেছিল। ডিরেক্টর সাহেব তাকে দেখে বললেন, এই ছেলের চেহারায় তো কোনো মায়া নেই। চোখ এক্সপ্রেশনলেস। একে দিয়ে হবে না।
মুহিব বলল, স্যার, আপনাদের তো মায়ার দরকার নেই। আপনাদের দরকার দাঁত। আমার দাঁত দেখুন। আমি আস্ত সুপারি দাঁত দিয়ে ভাঙতে পারি। একটা সুপারি অনুন, দাঁত দিয়ে ভেঙে দেখাচ্ছি। দশ সেকেন্ডের মামলা।
ডিরেক্টর সাহেব বললেন, বাসায় চলে যাও। বাসায় গিয়ে দাঁত দিয়ে সুপারি ভাঙ। ফাজিল ছোকরা।
মুহিব বিএ পাশ করেছে আট বছর আগে। একবারে সম্ভব হয় নি। দুবার পরীক্ষা দিয়ে থার্ড ডিভিশন পেয়েছে। রেজাল্ট বের হবার পর মুহিবের বাবা (আলাউদ্দিন আহমদ) ছেলেকে বললেন, বিএ-তে থার্ড ডিভিশন ফেলের চেয়েও খারাপ। কেউ রেজাল্ট জিজ্ঞেস করলে বলবি, ফেল করেছি।
মুহিব বাধ্য ছেলের মতো মাথা কাত করে বলল, জি আচ্ছা।
আলাউদ্দিন বললেন, থার্ড ক্লাসের সার্টিফিকেটটা হাতে আসলে ছাগলকে কাঠালপাতার সঙ্গে খেতে দিবি। থার্ড ক্লাস সার্টিফিকেট ছাগলের খাদ্য।
মুহিব বলল, ছাগল কোথায় পাব?
আলাউদ্দিন বললেন, খুঁজে বের করবি ঢাকা শহরে ছাগলের অভাব আছে?
মুহিব বলল, জি আচ্ছা।
আলাউদ্দিন বললেন, সকালে আমার সামনে। খবরদার পড়বি না তোর মুখ দেখে দিন শুরু হওয়া মানে দিনটাই নষ্ট। নিজের ঘরে ঘাপটি মেরে পড়ে থাকবি। আমি ঘর থেকে বের হলে রিলিজ হবি। মনে থাকবে?
থাকবে।
এখন সামনে থেকে তার সঙ্গে কথা বলা মানে আয়ুক্ষয়।
মুহির বাবার সামনে থেকে বের হয়ে রান্নাঘরে ঢুকে গেল। রান্নাঘরে মুহিবের। মা রাজিয়া বেগম রান্না বসিয়েছেন! এই মা মুহিবের সংসা। ভদ্রমহিলা সরুল। প্রকৃতির। মুহিবকে অসম্ভব পছন্দ করেন। তিনি বললেন, এই গাধা! কদমবুসি করেছিস?
মুহিব বলল, কদমবুসি করব কেন?
বিএ পাশ করেছিস, কদমবুসি করবি না? বিএ পাশ হওয়া সহজ কথা? কয়টা ছেলে আছে বিএ পাশ?
মুহিব মাকে কদমবুসি করল।
রাজিয়া বললেন শাড়ির আঁচলে তিন টাকা আছে]একশ টাকা নিয়ে যায় বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে মিষ্টি খাব। আমার হাত বন্ধ।
মুহিব শাড়ির আঁচল খুলে। তিনশ টাকার পুরোটাই নিয়ে নিল।
রাজিয়া বললেন, চুপ করে বসে থাকা বান্না শেষ করি। তারপরে হাত ধুয়ে তোর মাথায় হাত রেখে দোয়া করব। মায়ের দোয়া ছাড়া সন্তানের কিছু হয় না
মুহিব বলল, তুমি তো আমার মা না।
রাজিয়া বললেন-থাপড়ায়েত ফেলে দিব বদমাশ ছেলে। আমি মানাতো মা কে?
মুহিব ঝিম ধরে বসে রইল। মহিলা রান্না শেষ করে অজু করলেন। মুহিবের মাথায় হাত রেখে বললেন, হে আল্লাহপাক, এই ছেলেটা সত্যিকার মায়ের আদর কী জানে না। তুমি তার উপর দয়া কর।
মুহিব বিরক্তালীয় বলদ, এটা কী বললো মা!তুমি যে আদর কর এটা মিথ্যা?
মিথ্যা হবে কেন?
সত্যিকার মায়ের আদর কি তোমার আদরের চেয়ে আলাদা?
রাজিয়া বেগম চুপ করে গেলেন। কী বলবেন বুঝতে পারছেন না।
মুহিব বলল, আল্লাহপাকের সঙ্গে কথা বলছ, জেনে বুঝে বলবে না।
রাজিয়া বিব্রত গলায় বললেন, কী বলব বলে দে।
মুহিব বলল, তুমি বলো আমার এই ছেলেকে যেন কেউ দয়া না করে। উল্টা সে যেন সবাইকে দয়া করতে পারে।
রাজিয়া বেগম তোতাপাখির মতো বললেন, আমার এই ছেলেকে যেন কেউ দয়া না করে। উল্টা সে যেন সবাইকে দয়া করতে পারে।
মুহিবের চরিত্র বোঝার জন্যে তার একটা ঘটনা উল্লেখ করা জরুরি। সে বিএ সার্টিফিকেট হাতে পাওয়ার পর সত্যি সত্যি ছাগলকে দিয়ে সার্টিফিকেট খাইয়েছে। কোরবানি দেবার জন্যে আলাউদ্দিন তিনহাজার চারশ টাকায় একটা ছাগল কিনেছিলেন। লবণ মাখিয়ে সার্টিফিকেটটা তার সামনে ধরতেই ছাগল খেতে শুরু করল। আলাউদ্দিন বললেন, ছাগলকে কী খাওয়াচ্ছিস?