- বইয়ের নামঃ কে কথা কয়
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- প্রকাশনাঃ অন্যপ্রকাশ
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস, কল্পকাহিনী
কে কথা কয় (২০০৬) – উপন্যাস – হুমায়ূন আহমেদ
প্রথম প্রকাশ – একুশের বইমেলা ২০০৬
ভূমিকা
আমার মেজো মেয়ে শীলা তখন ক্লাস টু কিংবা থ্রিতে পড়ে। তার হোমওয়ার্কের খাতা উল্টেপাল্টে দেখছি–এক জায়গায় চোখ আটকে গেল। দেখি সে একটা সম্পূর্ণ লাইন উল্টো করে লিখেছে। এটা কি তার কোনো খেলা? ভালোভাবে দেখতে গিয়ে হতভম্ব। তার খাতাভর্তি এই ব্যাপার। অনেক লাইন উল্টো করে লেখা। আয়নার সামনে ধরলেই শুধু পড়া যায়। ডাক্তাররা বললেন, কিছু কিছু ইনফরমেশন তার মাথায় উল্টো করে আসে। ইংরেজিতে একে বলে Dyslexia। অটিস্টিক শিশুদের এরকম হয়।
অটিজম বা অটিস্টিক শিশুদের বিষয়ে সেই আমার সাঙ্গ পরিচয়। তারও অনেককাল পরে নুহাশ পল্লীতে একটি অটিস্টিক শিশুর সঙ্গে আমার দেখা হয়। বাবা-মা বাচ্চাটিকে নিয়ে বেড়াতে এসেছেন। তাকে ছেড়ে দিয়েছেন আম বাগানে। সে গম্ভীর ভঙ্গিতে হাঁটছে। মাঝে মাঝে নিচু হয়ে শুকনো পাতা কুড়িয়ে পকেটে রাখছে। বাচ্চাটার কাণ্ড দেখে মজা পেয়ে তার কাছে যাচ্ছি, বাচ্চার বাবা বিনীতভাবে বললেন, স্যার, যাবেন না। সে অপরিচিত কাউকে দেখলে প্রচণ্ড ভয় পায়। অপরিচিত কেউ তার গায়ে হাত দিলে সে অজ্ঞান হয়ে পড়ে। এছাড়া তার আর কোনো সমস্যা নেই। সে অসম্ভব মেধাবী একজন ছাত্র। শুকনোপাতা কুড়ানো ছেলেটির সঙ্গে আমার কোনো কথা হলো না। এই বিষয় নিয়ে কোনোদিন কিছু লিখব সেরকম ইচ্ছাও তৈরি হলো না।
বছর তিনেক আগে লন্ডন থেকে ট্রেনে করে স্কটল্যান্ড যাচ্ছি। পাঁচ-ছয় ঘণ্টার ট্রেন জার্নি। বাইরের দৃশ্য যত সুন্দরই হোক এত দীর্ঘ সময় জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব না। ট্রেনে পড়ার জন্যে একগাদা বই কিনলাম। এর মধ্যে একটা বইয়ের লেখিকা Karen Armstrong। তাঁর আত্মজীবনীমূলক বইটার নাম The Spiral Staircase। বইটিতে লেখিকা একটি অটিস্টিক শিশুর কথা লিখেছেন। কিছুদিন এমন একটি শিশুর তিনি বেবিসিটার ছিলেন।
কে কথা কয় উপন্যাসটির বীজ Karen Armstrong-এর বইটি থেকে এসেছে। আমি গবেষকটাইপ লেখক না যে, কিছু লেখার আগে বিস্তর গবেষণা করব। এই বইটিতে করতে হয়েছে। ইন্টারনেটের কারণে গবেষণা সহজ হয়ে গেছে। সব তথ্যই। আঙুলের মাথায়। বোতাম টিপতে পারলেই হলো।
Mark Haddon-এর লেখা–The curious incident of the dog in the night time বইটিও আমাকে খুব সাহায্য করেছে।
কে কথা কয় গাঢ় আনন্দ নিয়ে লিখেছি। আনন্দের কিছু ভাগ পাঠক পেলেই জন্ম সার্থক মনে করব।
হুমায়ূন আহমেদ
নুহাশ পল্লী
————–
০১.
এই মুহূর্তে অতি তুচ্ছ একটা বিষয় মতিনের মাথা আউলা-ঝাউলা করে দিচ্ছে। মতিনের উচিত বিষয়টা মাথা থেকে দূর করে সহজ স্বাভাবিক হয়ে যাওয়া। সে তা পারছে না। অতি তুচ্ছ চিন্তার বিষয়টা এরকম–মতিনের সামনে যিনি বসে আছে তিনি অবশ্যই জিজ্ঞেস করবেন, আপনার নাম কী? তখন মতিন কী বলবে? সে কি তার পুরো নামটা বলবে, সার্টিফিকেটে যে নাম আছে সেই নাম–মতিন উদ্দিন খান পাঠান? শুরুতেই ইমপ্রেশন খারাপ হয়ে যাবে না? এমন একজন ইন্টারভিউ দিতে এসেছে যার নামের শেষে খানও আছে পাঠানও আছে। পাঠান এমন পদবি যার শেষ অক্ষর বাদ দিলে হয়–পাঠা। চন্দ্রবিন্দু যুক্ত করলে বাংলার আদি অকৃত্রিম পাঁঠা।
সে বলতে পারে, স্যার, আমার নাম মতিন। এটাও হবে ভুল। ফরম্যাল ইন্টারভিউতে ডাকনাম বলা যায় না। মতিন উদ্দিন বলা যায়, তাতেও সমস্যা আছে। তখন তাকে প্রশ্ন করা হবে–সার্টিফিকেটে লেখা নাম মতিন উদ্দিন খান পাঠান, তুমি শুধু মতিন উদ্দিন বলছ কেন?
টেনশনে মতিনের পানির পিপাসা এবং ছোট বাথরুম একসঙ্গে পেয়ে গেল। মানুষের যখন তৃষ্ণা পায় তখন ছোট বাথরুম পায় না। আবার যখন ছোট বাথরুম পায় তখন তৃষ্ণা পায় না। মতিনের এই দুই জিনিস একসঙ্গে পায়। কেন পায় সে জানে না। ডায়াবেটিস হলে কী হয়? কে জানে তার হয়তো ভয়ঙ্কর ডায়াবেটিস আছে। পরীক্ষা করা হয় নি বলে এতদিন ধরা পড়ে নি। ডায়াবেটিস বিষয়ক নতুন চিন্তা মাথায় ঢুকতে চেষ্টা করছে। কিছুতেই এই চিন্তা মাথায় ঢুকতে দেয়া যাবে না। যিনি তার ইন্টারভিউ নিচ্ছেন তার বিষয়ে চিন্তা করতে হবে–সুপুরুষ একজন মানুষ। মাথার চুল পেকে গেছে, এই নিয়ে তিনি চিন্তিত নন। চুলে কলপ দেন না। ভদ্রলোক এখন সামান্য ঝুঁকে আসছেন। এখন কি প্রশ্ন করবেন?
তোমার নাম মতিন উদ্দিন খান পাঠান?
জি স্যার।
নামের শেষে দুটা পদবি সচরাচর দেখা যায় না।
স্যার, আমার নামটা রেখেছিলেন আমার বাবার পীর সাহেব। পীর সাহেবের দেশ ইউপিতে–সেখানে মনে হয় এই ধরনের নাম রাখা হয়।
তোমার পড়াশুনা কতদূর?
ইংরেজি সাহিত্যে অনার্স পাস করেছি। এমএ করার ইচ্ছা ছিল। টাকা পয়সা জোগাড় হয় নি। (আবার উত্তরে ভুল হয়ে গেল। টাকা-পয়সা জোগাড় হয় নি কথাটার মধ্যে ফকির ভাব আছে। করুণা প্রার্থনা। আমাকে দয়া কর, ভিক্ষা দাও টাইপ প্রার্থনা।)
অনার্সের রেজাল্ট কী?
রেজাল্ট ভালো না। সেকেন্ড ক্লাস। নিচের দিকে।
Autusic শব্দটার মানে জানো?
জি-না স্যার।
Autistic baby, Autistic children এ ধরনের শব্দ পাও নি?
জি-না।
মতিন পুরোপুরি হতাশ হয়ে গেল। সামান্য একটা শব্দের মানে না জানার জন্যে চাকরি হবে না, এটা ভাবতেও কষ্ট হচ্ছে। বড় বড় দুর্ঘটনা অতি সামান্য কারণে ঘটে। মতিনের বড় মামা কলা খেতে খেতে নিউমার্কেটের কাঁচাবাজার থেকে ফিরছিলেন। নিজের ছুড়ে ফেলা কলার খোসায় পা পিছলে তিনি উল্টে পড়ে গেলেন। লোকজন ধরাধরি করে তুলল, তিনি বসা অবস্থা থেকে আবার পড়ে গেলেন। তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো। ডাক্তার দেখে বললেন, মারা গেছে।