- বইয়ের নামঃ বকুলাপ্পু
- লেখকের নামঃ মুহম্মদ জাফর ইকবাল
- প্রকাশনাঃ অনন্যা
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
০১. ব্যাপারটা শুরু হয়েছিল এভাবে
ব্যাপারটা শুরু হয়েছিল এভাবে।
চন্দ্রা নদী তীর ভাঙতে ভাঙতে এগিয়ে এসে পলাশপুর গ্রামের বড় হিজল গাছটা পর্যন্ত এসে হঠাৎ করে থেমে গেল। হিজল গাছটার অর্ধেক তখন শূন্যে নদীর কালো পানির উপর ঝুলছে, বাকি অর্ধেক কোনভাবে মাটি কামড়ে আটকে আছে–দেখে মনে হয় যে-কোনমুহূর্তে পুরো গাছটা বুঝি পানিতে হুড়মুড় করে ভেঙে পড়বে। এই গাছটা ছিল পলাশপুর গ্রামের বাচ্চাকাচ্চাদের সবচেয়ে প্রিয় গাছ। তারা এর মোটা ডাল বেয়ে উপরে উঠত, মাঝারি ডালগুলোতে ঘোড়ার মতো চেপে বসে দুলত, সরু ডালগুলো ধরে ঝুল খেয়ে নিচে লাফিয়ে নামত। নদীর ভাঙনের মাঝে পড়ে যাওয়ায় প্রথম প্রথম বাচ্চারা কেউ এই গাছে উঠতে সাহস করত না। এক-দুই দিন যাবার পর গ্রামের দুর্দান্ত আর ডানপিটে কয়েকজন একটু একটু করে গাছটায় আবার ওঠা শুরু করল, কিন্তু ঠিক তখন জমিলা বুড়ি একদিন নদীর তীরে দাঁড়িয়ে হিজল গাছটা নিয়ে তার বিখ্যাত ভবিষ্যদ্বাণীটা ঘোষণা করল। তারপর আর কাউকে হিজল গাছের ধারেকাছে দেখা যায়নি।
এই এলাকার সবাই জানে জমিলা বুড়ির বয়স কম করে হলেও একশো পঞ্চাশ, তার কমপক্ষে এক ডজন পোষা জ্বীন আর পরী রয়েছে এবং জোস্নারাতে সে ‘গাছ-চালান’ দিয়ে শ্যাওড়া গাছে বসে আকাশে উড়ে বেড়ায়। তার মাথার চুল পাটের মতো সাদা, এই গ্রামের যারা থুরথুরে বুড়ো তারাও দাবি করে যে জন্মের পর থেকেই তারা জমিলা বুড়ির পাকা চুল দেখে আসছে। মানুষের বয়স বেশি হয়ে গেলে মাথার চুল পাতলা হয়ে যায়, কিন্তু জমিলা বুড়ির মাথাভরা সাদা চুল এবং সে দুই হাতে সবসময় তার মাথার চুল বিলি কাটতে থাকে। বয়স বেশি হওয়ার কারণে সে আর সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে না, হাতে একটা লাঠিতে ভর দিয়ে কেমন জানি ভঁজ হয়ে দাঁড়ায়। জমিলা বুড়ির লাঠি নিয়েও নানারকম গল্প রয়েছে–অনেকেই মনে করে এটা আসলে একটা শঙ্খচূড় সাপ, জমিলা বুড়ি জাদু করে লাঠি তৈরি করে রেখেছে। কবে নাকি এক চোর জমিলা বুড়ির কুঁড়েঘরে চুরি করতে গিয়েছিল, তখন বুড়ি তার লাঠি ছুঁড়ে দিতেই সেটা ফণা তুলে চোরকে ধাওয়া করেছিল, কোনমতে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে এসেছে সেই চোর। জমিলা বুড়ির পিঠে থাকে তালি-দেওয়া একটা ঝোলা। সেই ঝোলার ভিতরে কী থাকে সেটা নিয়েও নানারকম গবেষণা হয় যদিও সবাই একমত হতে পারে না। কেউ বলে ছোট ছোট বাচ্চাদের জাদু করে ইঁদুর নাহয় ব্যাঙে পালটে ফেলে সে ঝোলার মাঝে রেখে দেয়, কেউ বলে, তার ঝোলার মাঝে আটকা পড়ে আছে বেয়াদব ধরনের কিছু জ্বীন। জমিলা বুড়ি সবসময় বকবক করে কথা বলছে, দেখে মনে হতে পারে সে বুঝি নিজের সাথে কথা বলে, কিন্তু অভিজ্ঞ মানুষেরা দেখেই বুঝতে পারে যে সে তার পোষা জ্বীনদের সাথে কথা বলছে। কী বলছে সেটা অবিশ্যি বোঝা খুব কঠিন, দাঁতহীন ভোবড়ানো মুখের কথা শোনা গেলেও ঠিক বোঝা যায় না।
ছোট ছোট বাচ্চারা জমিলা বুড়ি থেকে দূরে দূরে থাকে, কোন্ সময় তাদের ধরে তার ঝোলার মাঝে ঢুকিয়ে নেবে সেই ভয়ে তারা ধারেকাছে আসে না। যারা একটু বড় এবং একটু বেশি সাহসী তারা মাঝে মাঝে জমিলা বুড়িকে দেখলে দূর থেকে চিৎকার করে জিজ্ঞেস করে, ‘জমিলা বুড়ি জমিলা বুড়ি–পাস না ফেল?’
জমিলা বুড়ি সাধারণত এইরকম প্রশ্নের উত্তর দেয় না, আপন মনে বিড়বিড় করে হাঁটতে থাকে। হঠাৎ কখনো কখনো ফোকলা-মুখে ফিক করে হেসে বলে, ‘পাস’। যাকে বলে তখন তার আনন্দ দেখে কে, জমিলা বুড়ি বলেছে ‘পাস’ অথচ সে পরীক্ষায় পাস করেনি এরকম ঘটনা পলাশপুর গ্রামে এখনও ঘটেনি।
সবাইকেই যে জমিলা বুড়ি ‘পাস’ বলে তা নয়। মাঝে মাঝে তার মেজাজ গরম থাকে, তখন সে তার লাঠি নিয়ে তাড়া করে বলে, ‘ফেল ফেল তোর চৌদ্দগুষ্ঠি ফেল। যাদেরকে এরকম অভিশাপ দেওয়া হয় তারা সাধারণত পড়াশোনা করা ছেড়ে দেয়। দেখা গেছে তারা শুধু যে পরীক্ষায় ফেল করে তাই নয় তাদের বাবারা মামলায় হেরে যায়, চাচাঁদের বাড়িতে চুরি হয়, মামাদের গরু মরে যায়, বোনদের বিয়ে হয় না (যদিবা বিয়ে হয় যৌতুক নিয়ে জামাইয়েরা বউদের মারধর করে)–এক কথায় তাদের জীবনে এই ধরনের হাজারো রকম ঝামেলা শুরু হয়ে যায়।
এই জমিলা বুড়ি একদিন নদীর তীর ধরে হাঁটতে হাঁটতে হিজল গাছটাকে দেখতে পেয়ে থমকে দাঁড়াল। যারা আশেপাশে ছিল তারা দেখল জমিলা বুড়ি গাছটাকে কিছু-একটা জিজ্ঞেস করল এবং গাছ যে উত্তরটা দিল সেটা তার পছন্দ হল না বলে লাঠি নিয়ে ঠুকঠুক করে হেঁটে হেঁটে কাছে গিয়ে গাছকে কষে লাথি দিয়ে গালিগালাজ করতে শুরু করল। গাছের সাথে জমিলা বুড়ির কী নিয়ে কথাবার্তা হয়েছে সেটা সাধারণ মানুষদের পক্ষে বোঝা কঠিন, কিন্তু তাদের দুজনের মাঝে যে খুব রাগারাগি হচ্ছে সেটা নিয়ে কারও কোনো সন্দেহ রইল না। শেষ পর্যন্ত দেখা গেল জমিলা বুড়ি তার লাঠি তুলে গাছকে অভিশাপ দিল, আগামী ‘চান্দের’ আগে এই গাছ নদীতে ভেসে যাবে। শুধু তাই না, এই গাছ যখন পানিতে হুড়মুড় করে পড়বে তখন একজন মানুষের জান কবজা করে নিয়ে যাবে।