- বইয়ের নামঃ উড়ালপঙ্খী
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- প্রকাশনাঃ অন্যপ্রকাশ পাবলিকেশন
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস, কল্পকাহিনী
আয়নার দিকে তাকিয়ে মুহিব চমকে উঠল
আয়নার দিকে তাকিয়ে মুহিব চমকে উঠল। কাকে দেখা যাচ্ছে আয়নায়? এটা কি তার নিজেরই ছায়া? না-কি এক চোখা দৈত্য–সাইক্লপ!
যাকে দেখা যাচ্ছে তার বা চোখ বন্ধ হয়ে আছে। খুব চেষ্টা করলে চোখের সাদা অংশ দেখা যায়, কালো মণি দেখা যায় না। গালের হনু উঁচু হয়ে আছে। থুতনির কাছে খোচা খোচা দাড়ি। গালের হনু তো আগে উঁচু ছিল না। বেছে বেছে আজই উঁচু হয়ে গেল? সারা মুখে কেমন চিমশে ভাব চলে এসেছে। রাতে না ঘুমুলে এরকম হয়। কিন্তু গত রাতে তার ঘুম খুব ভালো হয়েছে। ঘুমের মধ্যে সে ইন্টারেস্টিং একটা স্বপ্নও দেখেছে। স্বপ্নটা এখন মনে পড়ছে না। দুপুরের দিকে মনে পড়বে। মুহিবের স্বপ্ন মনে পড়ে দুপুরের পর।
এই চেহারা দুরুস্ত করা যাবে কীভাবে? শেভ করে থুতনির দাড়ি ফেলে দেয়া যাবে। ক্রিম ঘষে মুখের চিমশে ভাব হয়তো বা কিছুটা কাটান দেয়া যাবে। কিন্তু বা চোখের গতি কী হবে? এই চোখ নিয়ে প্রেমিকার সঙ্গে দেখা করতে যাওয়া যায়, কিন্তু চাকরির ইন্টারভিউ দিতে যাওয়া যায় না। আজ সকাল এগারোটায় দ্যা এরনস নামের একটা কোম্পানির সঙ্গে তার ইন্টারভিউ। তারা দ্বিতীয় দফায় ডেকেছে। দ্বিতীয়বার যখন ডাকছে তখন নিশ্চয়ই কোনো ঘটনা আছে। চোখের এই অবস্থা দেখলে কি ইন্টারভিউ বোর্ডের কর্তারা সেই বিশেষ ঘটনা ঘটাবেন? এখন বাজছে আটটা। হাতে আরো তিন ঘণ্টা সময় আছে। এই তিন ঘণ্টায় চোখের কোনো গতি করা যাবে কি?
জল-চিকিৎসা শুরু করলে কেমন হয়? যে-কোনো রোগের প্রথম চিকিৎসা হলো জল-চিকিৎসা। কিছু কিছু রোগের শুধু যে প্রথম চিকিৎসা তা-না, শেষ চিকিৎসাও। কথাগুলো মুহিবের বড় চাচা তৌফিকুর রহমান সাহেবের। পেনশন নিয়ে পাঁচ বছর ধরে তিনি বাড়িতে বসে আছেন। অবসর কাটাচ্ছেন নানাবিধ চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়ে পড়াশোনা করে। উনার কর্মকাণ্ড পড়াশোনায় সীমাবদ্ধ থাকলে ভালো হতো। তা নেই, তিনি বাড়িতে কিছু ভেষজ ওষুধও বানাতে শুরু করেছেন। তাঁর প্রথম প্রচেষ্টা Olive leaf extract. হামানদিস্তায় জলপাই গাছের কচিপাতা পেষা হচ্ছে। তার সঙ্গে আগার-আগার মিশিয়ে ডালের বড়ির মতো বড়ি বানিয়ে রোদে শুকানো হচ্ছে। শুকানোর পর এই ঘোর কৃষ্ণবর্ণ বস্তুটাকে দেখাচ্ছে ছাগলের লাদির মতো। এই ছাগলের লাদি দৈনিক একটা করে খেলে নবযৌবন। কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজ, আর্থরাইটিস, ডায়াবেটিস, ব্লাডপ্রেসার কিছুই থাকবে না। ছাগলের লাদি শরীরের সমস্ত দষিত পদার্থ ব্লটিং পেপারের মতো শুষে নিয়ে নিবে। শরীরে চলে আসবে কমনীয় কান্তি।
মুহিব গত চারদিনে চারটা ট্যাবলেট খেয়েছে। আজ যদি খায় তাহলে শরীরে পঞ্চম ডোজ পড়বে। চোখে প্রবল বেগে পানির ঝাপ্টা দিতে দিতে তার মনে হলো কোনো কারণ ছাড়াই এই যে তার চোখ ফুলে গেল, চেহারায় চিমশে ভাব চলে এসেছে, এইসব ছাগলের লাদির সাইড এফেক্ট না তো? যে ওষুধে নবযৌবন নিয়ে আসবে তার কিছু সাইড অ্যাফেক্ট তো থাকারই কথা। নবযৌবন নিয়ে আসবে ঠিকই, সঙ্গে সঙ্গে নবযৌবন প্রাপ্ত মানুষটার একটা চোখ বসিয়ে দিয়ে যাবে।
দরজায় টোকা পড়ছে। মুহিবের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছে, যে দরজায় টোকা দিচ্ছে। সে কোনো একটা কাজ নিয়ে এসেছে। কাজ ছাড়া ভোরবেলায় কেউ বেকার যুবকের কাছে আসে না। হয়তো সকালের নাস্তার ময়দা নেই। মোড়ের দোকান থেকে ময়দা আনতে হবে। কিংবা চিঠি নিয়ে এক্ষুণি কারোর বাসায় যেতে হবে। সেই লোক অফিসে চলে যাবার আগেই তাকে ধরতে হবে।
যিনি দরজা ধাক্কাচ্ছিলেন তিনি এখন স্ব-গলায় জানান দিলেন। বিরক্ত গলা— মুহিব! মুহিব!
মুহিবের বড়ভাবি ইয়াসমিনের গলা। এই মহিলা অনেক পরিশ্রম করে তার লায় স্থায়ী বিরক্তি নিয়ে এসেছেন। স্বাভাবিক গল্পগুজবের সময়ও তার গলায় রাজ্যের বিরক্তি ঝরে পড়ে। ভুরু কুঁচকে থাকে, চোখ সরু হয়ে যায়। মুহিব পানির কল বন্ধ করল। জল-চিকিৎসার এইখানেই ইতি।
এতক্ষণ ধরে দরজা ধাক্কাচ্ছি, ব্যাপার কী?
বাথরুমে ছিলাম ভাবি, শুনতে পাই নি।
তোমার কি এখন কোনো জরুরি কাজ আছে?
মুহিব হাসি মুখে বলল, আমার জরুরি কাজ থাকবে কী জন্যে?
ইয়াসমিন তীক্ষ্ণ গলায় বলল, প্রশ্নের জবাব প্রশ্ন দিয়ে দেবে না। কাজ আছে কি নেই সেটা বলো।
কাজ নেই।
মাঝারি সাইজের দুটা ডিমওয়ালা ইলিশ মাছ এনে দিয়ে যাবে। পদ্মার ইলিশ আনবে। বার্মিজ ইলিশ পাওয়া যায়। ভুলেও বার্মিজটা আনবে না।
বার্মিজ ইলিশ পদ্মার ইলিশ চিনব কীভাবে?
মাছওয়ালাকে জিজ্ঞেস করবে। পদ্মার ইলিশ গোলগাল হয়। বার্মিজটা হয় লম্বা টাইপের। মুখ বোচা। আধাকেজি সরিষা আনবে। পুরনো সরিষা আনবে না। পুরনোটা তিতা হয়। আধাকেজি নতুন রাই সরিষা। কাগজি লেবু। কাঁচামরিচ। দুইশ গ্রাম জিরা। মনে থাকবে?
অবশ্যই মনে থাকবে।
মনে থাকবে না। ভুলে যাবে, কাগজে লিখে নাও।
ভাবি, মনে থাকবে। আমার স্মৃতিশক্তি ভালো।
কী কী আনতে হবে বলো তো শুনি?
দুটা পদ্মার ইলিশ। আধাকেজি নতুন রাই সরিষা, কাগজি লেবু, কাঁচামরিচ, দুইশ গ্রাম জিরা। হয়েছে না? দশে দশ পেয়েছি কি-না বলো।
তুমি আসল ব্যাপারটাই ভুলে গেছ। ডিমওয়ালা ইলিশ। তোমার ভাই ইলিশ মাছ খাবে না। ইলিশ মাছের ডিমের ঝোল খাবে। এক হাজার টাকা রাখ। যা বাচে ফেরত দেবে।