- বইয়ের নামঃ ইস্টিশন
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- প্রকাশনাঃ অনন্যা
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস, কল্পকাহিনী
দ্বিতীয় বারের মতো স্কুল ফাইন্যাল ফেল
ইস্টিশন
ভূমিকা
জোছনার ফুল নামে একটা টিভি নাটক বানাব, তার জন্যে সেট ফেলেছি গাজীপুরে। জঙ্গলের ভেতর রেল স্টেশনের সেট। চমৎকার সেট তৈরী হল। মেকি রেল লাইন, রেল লাইনে শোলার পাথর। হার্ডবোর্ডের মালগাড়ীর ওয়াগান। এক জোছনা রাতে আমি সেট দেখতে গেলাম জঙ্গলের ভেতর। কি সুন্দর নির্জন রেল স্টেশন! মোটেও মেকি মনে হচ্ছে না। আমি রেল লাইন ধরে অনেক্ষণ হাঁটলাম। তারপর স্টেশনের প্লাটফর্মে চুপচাপ বসে রইলাম। রেল স্টেশনে আমি একা। দ্বিতীয় কোন মানুষ নেই। একসময় আমার গা কেন জানি। ছমছম করতে লাগল। তার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই মাথার ভেতর নির্জন গ্রামের রেল স্টেশনের গল্প ঢুকে গেল। এই হল ইস্টিশন লেখার ইতিহাস।
হুমায়ূন আহমেদ
নুহাশ পল্লী, গাজীপুর।
২৮-০৮-৯৯
————
০১.
আমার বড় ভাই দ্বিতীয় বারের মতো স্কুল ফাইন্যাল ফেল করে খুবই রেগে গেল। সাধারণ রাগ না, ভয়ংকর রাগ। কাছে গেলে ফোঁসফোঁস শব্দ পর্যন্ত শোনা যায়। বাবা আমাকে ডেকে বললেন, কয়েক দিন ওকে ঘাঁটাবি না। দূরেদূরে থাকবি। দ্বিতীয়বার ফেলটা সব সময় মারাত্মক। তিনবার ফেল করে ফেললে আবার সব স্বাভাবিক। ফেলটা তখন ডাল ভাতের মতো হয়ে যায়। যারা এমনিতেই রাগী স্বভাবের তিনবার ফেল করার পর তাদের মধ্যেও মোলায়েম ভাব চলে আসে। গলার স্বরও মেয়েলি হয়ে যায়। তিনবার ফেলের এটাই আসল মজা।
বাবা পাঞ্জাবির পকেট থেকে পঞ্চাশ টাকার একটা নোট বের করে বললেন, যা রঞ্জুর হাতে দিয়ে আয়। এই সময় হাতে টাকা পয়সা থাকলে মনটা শান্ত থাকে। মন শান্ত থাকা এখন বাঞ্ছনীয়। মন শান্ত না থাকলে উল্টাপাল্টা কিছু করে ফেলতে পারে।
আমি বাবার সঙ্গে ইস্টিশনঘর পর্যন্ত যাচ্ছি। ছুটির দিনে বাবাকে ইস্টিশনঘর পর্যন্ত এগিয়ে দেয়া আমার অনেক দিনের অভ্যাস। আগে তার আঙ্গুল ধরে ধরে যেতাম। এখন আঙ্গুল ধরতে লজ্জা লাগে। আঙ্গুল না ধরলেও তাঁর পাশাপাশি গা ঘেঁসা চাই। বাবার গা ঘেঁসে হাঁটলে তাঁর শরীরের ঘামের। গন্ধ পাওয়া যায়। বাবার ঘামের এই গন্ধটা খুবই মজার। বাবা দীর্ঘ নিশ্বাস। ফেলে বললেন, রঞ্জুর জন্যে বড়ই চিন্তাযুক্ত। উল্টাপাল্টা কিছু না করলেই হয়।
আমি বললাম, উল্টাপাল্টা কী করবে?
ধর ফাঁস নিয়ে ফেলল। তিন গজ নাইলনের দড়ি কিনে শিমুল গাছের ডালে ঝুলে পড়ল। তিন গজ এক নম্বুরি নাইলনের দড়ির দাম পনেরো টাকা। পনেরো টাকা যোগাড় করা কঠিন কিছু না। মেট্রিকের রেজাল্টের পর খুব কম হলেও দেড় দুইশ ছেলে ঝুলে পড়ে। গাছে ঝুলল, পুট করে জিব বের হয়ে পড়ল–সব শেষ।
কী সর্বনাশ!
সর্বনাশ বলে সর্বনাশ। গাছে—মাছে সর্বনাশ। স্কুলে আমার এক ক্লোজ ফ্রেন্ড ছিল বিধু। ভালো নাম বিধায়ক আমরা ডাকতাম বিন্দু বিধু। বিন্দুর মতো ছোট খাট বলেই বিন্দু বিধু। ইংরেজীতে BB, হিন্দু তো এই জন্যে পড়াশোনায় মারাত্মক টাইপ। হিন্দুরা পেয়াজ খায় না বলে পড়াশোনায় ভাল হয়। স্কুলে বরাবর ফার্স্ট হত। এই বিধু মেট্রিকে ফেল হয়ে গেল।
তুমি পাশ করলে?
প্রথম চান্সে পারি নি। আমাদের সময় প্রথম চান্সে কেউই পারত না। বিন্দু বিধু যে বার ফেল করল সেবার আমিও ফেল। সেকেন্ড চান্সে কেটে বের হয়ে গেলাম। আমার কথা বাদ দে বিধুর কথা শোন। ও যখন দেখল পত্রিকায় রোল নাম্বার নেই–তখন গরুর গলার দড়ি খুলে নিয়ে কাঁঠাল গাছে ঝুলে পড়ল। তখন নাইলনের দড়ি ছিল না। গরুর গলার গোবর মাখা দড়িই ভরসা। বিশ্রী অবস্থা। জিব বের হয়ে আছে। ধুতি লুঙ্গির মতো প্যাঁচ দিয়ে পরেছিল সেই ধুতি খুলে পড়ে গেছে। ইয়েটা দেখা যাচ্ছে। ফাঁস নিয়ে মরা মানুষের ইয়ে আবার খুবই লম্বা হয়ে যায়। একটা নেংটা মানুষ দড়িতে ঝুলছে। কেউ যে গিয়ে ধুতি পরিয়ে দেবে সেই উপায় নেই। পুলিশ আসার আগে কিছুই করা যাবে না। যে এই কাজ করবে পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে যাবে। হাজতে ঢুকিয়ে রুলের ডলা দেবে। ফাঁসির মরা কখনো দেখেছিস?
না।
খবর্দার দেখবি না। রাতের ঘুম হারাম হয়ে যাবে। এক সপ্তাহ ভাত খেতে পারবি না।
বাবা পাঞ্জাবির পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করলেন। সিগারেট খাবার সময় বাবা কোনো কথা বলেন না। খুবই উদাস হয়ে থাকেন। তখন তাঁকে দেখে মনে হয় তিনি খুবই দুঃখী একজন মানুষ। বাস্তবে তিনি মোটেই দুঃখী মানুষ না, হাসি খুশি মানুষ। তাঁকে আমি কখনো রাগতে দেখি নি, উঁচু। গলায় কথা বলতে শুনি নি। মা যখন বাবার সঙ্গে রাগারাগি করেন, বাবা খুব আগ্রহ নিয়ে মার কথা শুনেন। তখন তাঁকে দেখে মনে হয় মার প্রতিটি কথায় তিনি মজা পাচ্ছেন। মার রাগ যখন শেষ সীমায় চলে যায় তখন বাবা বলেন, সুরমা তোমার প্রতিটি কথাই কারেক্ট। আমি তোমার সঙ্গে এগ্রি করছি। সেন্ট পারসেন্ট এগ্রি। এখন তুমি আমাকে যা করতে বলবে, আমি করব। পায়ে
ধরতে বললে ধরব। নো প্রবলেম। স্ত্রী যদি স্বামীর পায়ে ধরতে পারে। স্বামীও পারে। এতে কোনো পাপ হয় না। স্বামী স্ত্রীর একে অন্যের পায়ে ধরা জায়েজ আছে।
বাবার এ ধরণের কথায় হঠাৎ মার মধ্যে একটা বিস্ফোরণের মতো হয়। তিনি হাতের কাছে যা পান ছুঁড়ে মারতে শুরু করেন। বাবাকে তখন খুবই অসহায় লাগে। যত অসহায়ই লাগুক এই সময় বাবার আশেপাশে থাকা খুবই বিপজ্জনক বলে আমি কখনো থাকি না। থাকি না বলেই জানি না, ঝড়টা কী ভাবে কাটে। কী ভাবে বাবা মার মধ্যে মিলমিশ হয়। শুধু এক সময় দেখা যায়। বাবা ভেতরের বারান্দায় বেতের মোড়ায় বসে পান খাচ্ছেন। মা আঙুলের ডগায় করে বাবার জন্যে চুন নিয়ে এসেছেন। বাবা মার আঙুল থেকে নিজের আঙুলে চুন নিয়ে আয়েশ করে জিবের ডগায় লাগাচ্ছেন। আঙুল থেকে আঙুলে চুন নেয়া খুবই অলক্ষুণে। এতে সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যায়। শুধু স্বামী স্ত্রীর বেলায় সুলক্ষণ। স্বামী-স্ত্রীর বেলাতেই শুধু আঙুল থকে আঙুলে চুন নিলে সুসম্পর্ক হয়।