- বইয়ের নামঃ আমাদের সাদা বাড়ি
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- প্রকাশনাঃ সময় প্রকাশন
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস, কল্পকাহিনী
আমাদের বাড়িতে হইচই
আমাদের বাড়িতে সকালের দিকে হইচই একটু বেশি হয়।
আমার মা, বয়সের কারণেই হোক কিংবা অন্য যে কোনো কারণেই হোক সকালবেলায় রেগে আগুন হয়ে থাকেন। যাকে দেখেন তার ওপর দিয়ে ঝড় বয়ে যায়। ঝড়ের প্রবল ঝাপ্টা বেশিরভাগ সময় আমার বড় ভাইয়ের ওপর দিয়ে যায়। বেচারার দোষ তেমন কিছু থাকে না— হয়তো। টুথপেস্টের টিউবের মুখ লাগানো হয়নি, কিংবা বাথরুমের পানির কল খোলা–এই জাতীয় তুচ্ছ ব্যাপার। রেগে আগুন হবার মতো কিছু না।
আজো বেচারা বকা খাচ্ছে। মার গলা ক্রমেই উঁচুতে উঠছে। অন্যপক্ষ চুপচাপ। বড় ভাই আত্মপক্ষ সমর্থন করেও কিছু বলছেন না, কারণ কথা বললেই বিপদ। আত্মরক্ষার একমাত্র উপায়— নীরবতা। মার একতরফা কথাবার্তা থেকে যা বোঝা যাচ্ছে তা হচ্ছে বুনোভাই দাড়ি শেভ করেন নি। বড় ভাইয়ের ডাকনাম বুনো। আমরা সবাই তাকে বুনোভাই ডাকি। যার নাম বুনো তাঁর স্বভাব-চরিত্রে বন্যভােব প্রবল হওয়ার কথা। তা কিন্তু না। বুনোভাই খুব শান্ত স্বভাবের মানুষ। এই যে মা তুফান মেল চালাচ্ছেন তিনি একটা শব্দও করছেন না। মিটমিটি হাসছেন।
মা হড়বড় করে বলছেন, তুই ভেবেছিস কী? তোর অনেক যন্ত্রণা সহ্য করেছি। গতকালও তুই শেভ করিস নি। আজো না। তোর মুখভর্তি খোচা খোচা দাড়ি। ঘরে কি ব্লেড কেনার টাকা নেই? নাকি তোকে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে দেয়া হয় না? হাসছিস কেন? এত কিছু শোনার পরেও তোর হাসি আসে? হাসি খুব সস্তা হয়ে গেছে?
মারা গালাগালির সঙ্গে তাল মিলিয়ে ঘটাং ঘটাং শব্দ হচ্ছে। শব্দটা টিউবওয়েলের। টিউবওয়েলের পাম্প চেপে আমরা দোতলার ছাদে পানি তুলি। ট্যাঙ্কে পানি তোলার জন্য আমাদের কোন ইলেকট্রিক পাম্প নেই। ওয়ান হর্স পাওয়ারে একটা পাম্প কিনলেই কাজ হয়। সেই পাম্প কেনা হচ্ছে না, কারণ আমার বাবার স্বাস্থ্য বাতিক। তিনি ঘোষণা করেছেন সকাল বেলা সবাইকে খানিকক্ষণ টিউবওয়েলে পানি পাম্প করতে হবে। এতে এক ঢিলে দুই পাখি মারা হবে। পানি তোলা হবে, স্বাস্থ্যও রক্ষা হবে। শুরুতে আমরা সবাই বেশ উৎসাহ নিয়ে পানি তুলেছি। এখন আর উৎসাহ পাচ্ছি না। এ বাড়ির একমাত্র কাজের ছেলে জিতু মিয়ার জীবন শেষ হয়ে যাচ্ছে। সে হাড় জিরজিরে শরীরে মিনিট বিশেক পাম্প করে তারপর দুহাতে বুক চেপে বসে পড়ে। বড় বড় করে নিঃশ্বাস নেয়। এই দৃশ্য দেখলে যে কোন লোক ভাববে, আমরা বোধহয় হৃদয়হীন। তবে দেখে দেখে আমাদের অভ্যোস হয়ে গেছে বলেই এখন আর খারাপ লাগে না। শুধু বুনোভাই এখনো অভ্যস্ত হতে পারেন নি। তিনি রোজই জিতু মিয়াকে সাহায্য করতে যান এবং একনাগাড়ে খুব কম করে হলেও একঘণ্টা ঘটাং ঘটাং করেন। এমন চমৎকার একটি ছেলের উপর মা শুধু শুধু এত রাগ করেন, কে জানে কেন।
অন্যদিন মিনিট দশেকের মধ্যেই মার দম ফুরিয়ে যায়। আজ ফুরুচ্ছে না। এখন বুনোভাইয়ের অকৰ্মণ্য স্বভাবের ওপর লেকচার দেয়া হচ্ছে। তাঁকে তুলনা করা হচ্ছে অজগর সাপের সঙ্গে। যে অজগর একটা আস্ত হরিণ গিলে এক মাস চুপচাপ শুয়ে থাকে। মার এই উপমা খুব খারাপ না। অজগর সাপের শুয়ে থাকার সঙ্গে বুনোভাইয়ের বিছানায় পড়ে থাকার মধ্যে বেশ মিল আছে। তাকে টেবিল-চেয়ারে বসে কোনদিন পড়তে দেখি নি। যাবতীয় পড়াশোনা তিনি করেন শুয়ে শুয়ে।
তুই হচ্ছিস অজগর, বুঝলি? অ-তে যে অজগর, সেই অজগর।
ঠিক আছে মা, এখন শান্ত হও। আমাকে বকে বকে তুমি ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। তুমি একটু বিশ্রাম নাও মা। শান্ত হও।
মা শান্ত হলেন না। আরো কী-সব বলতে লাগলেন। মার চিৎকার প্রাস জিতু মিয়ার ঘটাং ঘটাং-এর সঙ্গে যুক্ত হল আমার বড়। আপার দুই কন্যা রিমি ও পলির চিৎকার। এই দুই কন্যা কান ঝালাপালা করে দিতে লাগল। বড়। আপা গত চার মাস ধরে আমাদের সঙ্গে আছেন। আরো দু মাস থাকবেন, কারণ দুলাভাই কী একটা ট্রেনিঙে নিউজিল্যান্ডে গিয়েছেন ছমাসের জন্য। রিমি এবং পলি এই চার মাসে চিৎকার করে আমাদের মাথার পোকা নাড়িয়ে দিয়েছে। এদের কিছু বলার উপায় নেই। কিছু বললেই সত্য-মিথ্যা মিশিয়ে এরা তাদের মার কাছে নালিশ করবে এবং লোক-দেখানো নাকীকান্না কাঁদবে। আমি একবার মহাবিরক্ত হয়ে বলেছিলাম, এই রিমি, আর শব্দ করলে চড় খাবি। জন্মের মতো চিৎকার করার শখ মিটিয়ে দেব। রিমি চোখ বড় বড় করে খানিকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর লাফাতে লাফাতে তার মার কাছে গেল। বড় আপা সঙ্গে সঙ্গে আমার কাছে চলে এলেন। তাঁর মুখ থমথমে, গলার স্বর ভারি। মনে হচ্ছে কথা বলতে বলতে কেঁদে ফেলবেন। তার কান্নারোগ আছে।
রঞ্জু, তোর সঙ্গে আমার কথা আছে।
কী কথা?
দরজাটা বন্ধ করা, বলছি।
এমন কী কথা যে দরজা বন্ধ করে বলতে হবে?
বড় আপা নিজেই দরজা বন্ধ করে আমার সামনের চেয়ারে এসে বসলেন এবং চাপা গলায় বললেন, আমার মেয়েগুলোকে তুই দেখতে পারিস না কেন? ওরা কী করেছে?
আমি পরিবেশ হালকা করার জন্য হাসতে হাসতে বললাম, কী যে বল আপা, ওদের তো আমি খুবই পছন্দ করি। পরীর মতো দুই মেয়ে। দেখতে পারব না কেন?