- বইয়ের নামঃ এক ডজন একজন
- লেখকের নামঃ মুহম্মদ জাফর ইকবাল
- প্রকাশনাঃ সময় প্রকাশন
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
১. যখন একটি বাসা
১. যখন একটি বাসা দেখতে খুবই সাধারণ কিন্তু আসলে সেটি অসাধারণ
বাসাটা দেখে প্রথমে কেউই বুঝতে পারবে না যে এটা অত্যন্ত বিচিত্র একটা বাসা। বাইরে থেকে দেখতে এটা খুবই সাধারণ। হালকা হলুদ রঙের চারতলা একটা বিল্ডিং, পাশে বেশ খানিকটা খালি জায়গা, সেখানে নানা সাইজের গাছ। কিন্তু কেউ যদি একটু খুঁটিয়ে দেখে তাহলেই তার মনের ভিতরে নানারকম খটকা লাগতে শুরু করবে। যেমন বাসার গেটের পাশে কালো রঙের গ্রানাইট পাথরে রূপালি অক্ষরে খুব সুন্দর করে লেখা আছে, খা খা খা বক্কিলারে খা! একটা বাসার সামনে কেন এই কথাগুলো লেখা থাকবে সেটা নিয়ে যে কোনো মানুষের মনে সন্দেহ হতে পারে। আসলে এটা এই বাসার নাম।
মানুষ বাসার নাম রাখে নাহার মঞ্জিল কিংবা চৌধুরী ভিলা। যারা আধুনিক তারা নাম রাখে ব্ল্যাকবেরী কিংবা সানথিলা। যাদের ভেতরে একটা কবি কবি ভাব আছে তারা নাম রাখে নিশীথে কিংবা বনলত। তাই বলে খা খা খা বৰ্কিলারে খা? এটা কী কখনো একটা বাসার নাম হতে পারে? এই বাসার মানুষগুলোর সাথে সেটা নিয়ে কথা বলে লাভ নেই, একটা বাসার নাম যে খা খা খা বৰ্কিলারে খা হতে পারে না সেটা তারা জানেই না। বাংলার একজন প্রফেসর তাদের বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন যে বকিলা বলে কোনো শব্দ নেই, শব্দটা বখিল বা কৃপণ। সাপুড়েরা সাপের খেলা দেখানোর সময় যারা পয়সা দিতে চায় না তাদেরকে ভয় দেখানোর জন্য এটা বলে। কিন্তু এই বাসার মানুষগুলোর শব্দের অর্থ বা উচ্চারণ নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই, একটা কথা তাদের পছন্দ হয়েছে, ব্যাস, সেটা দিয়েই তাদের বাসার নাম রেখে ফেলেছে।
বাসাটা যদি কেউ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে তাহলে তার ভেতরে আরো কিছু বিষয় নিয়ে খটকা লাগতে পারে। যেমন ধরা যাক সবচেয়ে বড় গাছের ওপরে কাঠ, বাঁশ প্লাইউড এবং প্লাস্টিক দিয়ে তৈরি ঘরটার কথা। কেন। একটা গাছের উপর ঘর সেটা এমনিতে কেউ বুঝতে পারবে না, কিন্তু যারা এই বাসা আর বাসার মানুষজনকে চিনে তারা জানে এই বাসার একজন একবার ঠিক করেছিল যে সে তার বাকি জীবন গাছের উপর কাটিয়ে দিবে। এবং সেজন্যে গাছের উপর এই ঘরটা তৈরি করা হয়েছিল। অন্য কোনো কারণ নয় গাছের উপর থেকে বাথরুম করার অসুবিধের জন্যে শেষ পর্যন্ত এই অসাধারণ পরিকল্পনাটা বাতিল করতে হয়েছিল।
যদি কেউ আরেকটু এগিয়ে এসে আরেকটু ভালো করে লক্ষ্য করে তাহলে দেখবে দোতালা থেকে একটা মোটা দড়ি একটা গাছের মগডালে বেঁধে রাখা হয়েছে। বাইরের মানুষজন কোনোদিন কল্পনাও করতে পারবে না এই বাসার সবচেয়ে দুষ্টু ছেলেটা এই দড়ি ধরে ঝুলে গাছের মগডালে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল। সত্যি সত্যি সে পৌঁছেও গিয়েছিল কিন্তু নিজেকে সামলাতে না পেরে প্রচণ্ড বেগে সে গাছের ডালে ধাক্কা খেয়েছিল। সেই ধাক্কায় তার সামনের দুটো দাঁত এবং নাকের হাড়টা ভেঙ্গে গিয়েছিল। সামনের দুটো দাঁত আবার উঠেছে কিন্তু নাকের হাড়টা আর জোড়া লাগেনি বলে তার নাকটা একটু বাঁকা। সেটা নিয়ে কেউ খুব বেশি দুশ্চিন্তা করে না। কারণ সবাই জানে সে যখন আস্তে আস্তে আরো বড় হবে তখন নাকের হাড় থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ জিনিস ভেঙ্গেচুরে যাবে, কেটে-কুটে যাবে, ঝলসে এবং পুড়ে যাবে। এই বাসার মানুষজন জানে যে এই অসাধারণ দুষ্টু, ছেলেটির দুষ্টুমির ঘটনাগুলো ছবি তুলে কিংবা ভিডিও করে রাখা দরকার, কারণ এরকম অকাট্য প্রমাণ না দিলে ভবিষ্যতে কেউ বিশ্বাস করবে না যে একজন মানুষের মাথা থেকে এরকম বিচিত্র দুষ্টুমির আইডিয়া বের হতে পারে। পৃথিবীতে গণিত কিংবা বিজ্ঞানের অলিম্পিয়াড হয় দুষ্টুমির অলিম্পিয়াড হলে এই দুষ্টু বাচ্চাটি দেশের জন্যে অনেকগুলো গোল্ড মেডেল নিয়ে আসতে পারতো।
কেউ যদি এই বিচিত্র বাসাটা আর তার এক পাশের ফাঁকা জায়গাটা আরো ভালো করে লক্ষ্য করে তাহলে সে আরো বিচিত্র কিছু জিনিস দেখতে পাবে। যেমন ফাঁকা জায়গাটার মাঝামাঝি একটা বিদঘুটে গর্ত দেখে সে অবাক হয়ে ভাবতে পারে কেন এটা করা হয়েছিল। এটাও একটা পরিত্যক্ত প্রজেক্ট, একটা কুমিরকে পোষার জন্যে এখানে একটা পুকুর খোদাই করার চেষ্টা করা হয়েছিল। সেই পুকুরে প্রচুর পানি আর লবণ ঢালা হয়েছিল কিন্তু শেষ পর্যন্ত কুমিরের বাচ্চা জোগাড় করা যায়নি বলে এই প্রজেক্টটা বাতিল করতে হয়েছিল। এই গর্তটাকে কী কাজে লাগানো যায় সেটা নিয়ে এই বাসার মানুষজন মাঝে মাঝেই চিন্তা ভাবনা করে। এখন পর্যন্ত যতগুলো প্রস্তাব এসেছে তার মাঝে সবচেয়ে ভালো প্রস্তাবটি দিয়েছেন এই বাসার সবচেয়ে বয়স্ক মানুষটি। তার নাম রাহেলা খাতুন কিন্তু তাকে এই নামে ডাকার মতো কেউ নেই। তার ছেলে মেয়ে এবং ছেলের বউ আর মেয়ের জামাইরা তাকে মা বলে ডাকে। তার নাতি নাতনিদের তাকে দাদি কিংবা নানি ডাকার কথা, কিন্তু তারা নানি দাদি ডাকার পাশাপাশি মাঝে মাঝেই তাকে মা ডেকে ফেলে। যদিও রাহেলা খাতুনের অনেক বয়স হয়েছে কিন্তু তার চেহারায় মোটেও বয়সের ছাপ পড়েনি, তার মাথার চুল এখনো কালো, মুখের চামড়া মসৃণ এবং দাঁতগুলো ঝকঝকে। যারা তাকে চেনে না তারা তাকে তার ছেলে মেয়ের বড়বোন বলে সন্দেহ করে।