- বইয়ের নামঃ দৃষ্টি প্রদীপ
- লেখকের নামঃ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
- প্রকাশনাঃ জোনাকী প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
১. জ্যাঠামশায়দের রান্নাঘরে
দৃষ্টি প্রদীপ– উপন্যাস– বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
০১.
জ্যাঠামশায়দের রান্নাঘরে খেতে বসেছিলাম আমি আর দাদা। ছোট কাকীমা ডাল দিয়ে গেলেন, একটু পরে কি একটা চচ্চড়িও নিয়ে এলেন। শুধু তাই দিয়ে খেয়ে আমরা দু’জনে ভাত প্রায় শেষ করে এনেছি এমন সময় ছোট কাকীমা আবার এলেন। দাদা হঠাৎ জিজ্ঞেস করলে–কাকীমা, আজ মাছ ছিল যে, মাছ কই?
আমি অবাক হয়ে দাদার মুখের দিকে চাইলাম, লজ্জা ও অস্বস্তিতে আমার মুখ রাঙা হয়ে উঠল। দাদা যেন কি! এমন বোকা ছেলে যদি কখনো দেখে থাকি! আমার অনুমানই ঠিক হ’ল, কাকীমা একটু অপ্রতিভের সুরে বললেন–মাছ যা ছিল, আগেই উঠে গেছে বাবা, ওই দিয়ে খেয়ে নাও। আর একটু ডাল নিয়ে আসবো?
দাদার মুখ দেখে বুঝলাম, দাদা যেন হতাশ হয়েছে। মাছ খাবার আশা করেছিল, তাই না পেয়ে। মনটায় আমার কষ্ট হ’ল। দাদা দেখেও দেখে না, বুঝেও বোঝে না–দেখছে এখানে আমরা কি অবস্থায় চোরের মত আছি, পরের বাড়ি, তাদের হাত-তোলা দু-মুঠো ভাতে কটি ভাইবোন কোনরকমে দিন কাটিয়ে যাচ্চি, এখানে আমাদের না আছে জোর, না আছে কোনো দাবি–তবুও দাদার চৈতন্য হয় না, সে আশা করে বসে থাকে যে এই বাড়ির অন্যান্য ছেলেদের মত সেও যত্ন পাবে, খাবার সময় ভাগের মাছ পাবে, বাটি-ভরা দুধ পাবে, মিষ্টি পাবে। তা পায়ও না, না পেয়ে আবার হতাশ হয়ে পড়ে, আশাভঙ্গের দৃষ্টিতে এদিক-ওদিক চায়–এতে আমার ভারি কষ্ট হয়, অথচ দাদাকেও আসল অবস্থাটা খুলে বলতে পারিনে, তাতেও কষ্ট হয়।
দাদা বাইরে এসে বললে–মাছ তো কম কেনা হয়নি, তার ওপর আবার মাঠের পুকুর থেকে মাছ এসেছিল–এত মাছ সব হারু আর ভুন্টিরা খেয়ে ফেলেচে! বাবারে, রাক্কোস সব এক-একটি! একখানা মাছও খেতে পেলাম না।
দাদাকে ভগবান এমন বোকা করে গড়েছিলেন কেন তাই ভাবি।
সীতা এ-সব বিষয়ে অত্যন্ত বুদ্ধিমতী। এই সে-দিনও তো দেখেচি সীতা রান্নাঘরে খেতে বসেচে-সামনেই জ্যাঠাইমাও খেতে বসলেন। জ্যাঠাইমাকে ভুবনের মা এক কাঁসি মাছের তরকারি দিয়ে গেল, বড় বড় দাগা মাছ আট-দশখানা তাতে–আর সীতাকে দিলে তার বরাদ্দমত একটুকরো–জ্যাঠাইমা মাছ যত পারলেন খেলেন, বাকীটা কাঁসিতেই রেখে দিলেন, সেই পাতে তাঁর ভাগ্নে-বৌ বসবে। সীতার পাতে তো একখানা মাছও নিজের পাত থেকে দিতে পারতেন। কিন্তু কই, তা নিয়ে সীতা তো কখনো কিছু বলে না, দুঃখ করে না, নালিশ করে না! আমি জানতে পারলাম এই জন্যে যে, আমি সে-সময় নিতাইকাকার জন্যে আগুন আনতে রান্নাঘরে গিয়েছিলাম-সীতা কোন কথা আমায় বলেনি। এ বাড়ির কাণ্ডই এ রকম, আজ এক বছরের ওপর তো দেখে আসছি। অবিশ্যি নিজের জন্য আমি গ্রাহ্যও করিনে, আমার দুঃখ হয় ওদের জন্যে।
মায়ের দুঃখও এ বাড়িতে কম নয়। অত খাটুনির অভ্যেস মায়ের ছিল না কোনো কালে। এই শীতকালে মাকে গোছা গোছা বাসন নিয়ে ভোরে পুকুরের জলে নামতে হয়, মা’কে আর সীতাকে। খিড়কি পুকুরের জল সকালে থাকে ঠাণ্ডা বরফ, রোদ তো পড়ে না জলে কোন কালেই, চারিধারে বড় বড় আম আর সুপুরির বাগান। এতটুকু রোদ আসে না ঘাটে, সেই কনকনে হিমজলে বসে বাসন মাজা, যেমন তেমন করে মাজলে তো এ বাড়িতে চলবে না, কোথাও দাগ থাকবার জো নেই একটু, জ্যাঠাইমা দেখে নেবেন নিজে। সে যে কি কষ্ট হয় মায়ের, মা মুখ বুজে কাজ করে যান, বলেন না কিছু, আমি তো বুঝতে পারি! ও-সব কাজ কি মা করেছেন কখনো?
সকলের চেয়ে কাজ বাড়ে পুজো-আচ্চার দিনে–এ বাড়িতে বারো মাসের বারোটা পূর্ণিমাতে নিয়মিত ভাবে সত্যনারায়ণের সিন্নি হয়। গৃহদেবতা শালগ্রামের নিত্যপূজা তো আছেই। তা ছাড়া লক্ষ্মীপূজা মাসে একটা লেগেই থাকে। এ-সব দিনে সংসারের দৈনিক বাসন বাদে পুজোর বাসন বেরোয় ঝুড়িখানেক। এঁদের সংসার অত্যন্ত সাত্বিক গোঁড়া হিন্দুর সংসার–পুজো-আচ্চার ব্যাপারে পান থেকে চুন খসবার জো নেই। সে ব্যাপারে দেখাশুনো করেন জ্যাঠাইমা স্বয়ং। ফলে ঠাকুরঘরের কাজ নিয়ে যাঁরা খাটাখাটুনি করেন, তাঁদের প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে ওঠে।
পুজোর বাসন যে-দিন বেরোয়, মা সে-দিন সীতাকে সঙ্গে নিয়ে যান ঘাটে। সে যতটা পারে মাকে সাহায্য করে বটে, কিন্তু একে সে ছেলেমানুষ, তাতে ও-সব কাজে তার অভ্যেস নেই একেবারেই। জ্যাঠাইমার পছন্দমত পুজোর বাসন মাজতে সক্ষম হওয়া মানে অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া–বরং বোধ হয় শেষেরটাই কিছু সহজ। জ্যাঠাইমা বলবেন,–কোষাকুষি মাজবার ছিরি কি তোমার সেজবৌ? কতদিন ব’লে দিইচি তামার পাত্তরে তেঁতুল নেবু না দিলে ম্যাড়ম্যাড় করবেই–শুধু বালি দিয়ে ঘষলে কি আর– ঠাকুরদেবতার কাজগুলোও তো একটু ছেদ্দা করে লোকে করে? সব তাতেই খিরিস্টানি–
মা জবাব খুঁজে পান না। যদি তিনি বলতে যান–না বড়দি, নেবু ঘষেই তো ঠাকুর ঘরের তামার বাসন বরাবরই–
জ্যাঠাইমা বাধা দিয়ে বলবেন,–আমার চোখে তো এখনো ঢ্যালা বেরোয়নি সেজবৌ? অম্বলতা দিয়ে বাসন মাজলে অমনি ছিরি হয় বাসনের? কাকে শেখাতে এসেচ? কি বলব, ভুবনের মা হেঁসেলের কাজ সেরে সময় করতে পারে না, নইলে বাসন-মাজা কাকে বলে–