- বইয়ের নামঃ মিসমিদের কবচ
- লেখকের নামঃ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
- প্রকাশনাঃ গদ্যপদ্য
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
১. শ্যামপুর গ্রাম
মিসমিদের কবচ – কিশোর উপন্যাস – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
প্রথম পরিচ্ছেদ
শ্যামপুর গ্রামে সেদিন নন্দোৎসব।
শ্যামপুরের পাশের গ্রামে আমার মাতুলালয়। চৌধুরী-বাড়ির উৎসবে আমার মামার বাড়ির সকলের সঙ্গে আমারও নিমন্ত্রণ ছিলসুতরাং সেখানে গেলাম।
গ্রামের ভদ্রলোকেরা একটা শতরঞ্জি পেতে বৈঠকখানায় বসে আসর জমিয়েচেন। আমার বড়ো মামা বিদেশে থাকেন, সম্প্রতি ছুটি নিয়ে দেশে এসেচেনসবাই মিলে তাঁকে অভ্যর্থনা করলে।
এই যে আশুবাবু, সব ভালো তো? নমস্কার!
নমস্কার। একরকম চলে যাচ্ছেআপনাদের সব ভালো?
ভালো আর কই? জ্বরজাড়ি সব। ম্যালেরিয়ার সময় এখন, বুঝতেই পারছেন।
আপানার সঙ্গে এটি কে?
আমার ভাগনে, সুশীল। আজই এসেচেনিয়ে এলাম তাই।
বেশ করেচেন, বেশ করেছেন, আনবেনই তো। কী করেন বাবাজি?
এখানে আমি মামাকে চোখ টেপবার সুবিধে না পেয়ে তাঁর কনিষ্ঠাঙ্গুলি টিপে দিলাম।
মামা বললেনঅফিসে চাকরি করে কলকাতায়।
বেশ, বেশ। এসো বাবাজি, বোসো এসে এদিকে।
মামার আঙুল টিপবার কারণটা বলি। আমি কলকাতার বিখ্যাত প্রাইভেট-ডিটেকটিভ নিবারণ সোমের অধীনে শিক্ষানবিশি করি। কথাটা প্রকাশ করবার ইচ্ছা ছিল না আমার।
নন্দোৎসব এবং আনুষঙ্গিক ভোজনপর্ব শেষ হল। আমরা বিদায় নেবার জোগাড় করচি, এমন সময় গ্রামের জনৈক প্রৌঢ় ভদ্রলোক আমার মামাকে ডেকে বললেন–কাল আপনাদের পুকুরে মাছ ধরতে যাবার ইচ্ছে আছে, সুবিধে হবে কী?
বিলক্ষণ! খুব সুবিধে হবে! আসুন না গাঙ্গুলিমশায়, আমার ওখানেই তাহলে দুপুরে আহারাদি করবেন কিন্তু।
না না, তা আবার কেন? আপনার পুকুরে মাছ ধরতে দিচ্ছেন এই কত, আবার খেয়ে বিব্রত করতে যাব কেন?
তাহলে মাছ ধরাও হবে না বলে দিচ্চি। মাছ ধরতে যাবেন কেবল এই এক শর্তে।
গাঙ্গুলিমশায় হেসে রাজি হয়ে গেলেন।
পরদিন সকালের দিকে হরিশ গাঙ্গুলিমশায় মামার বাড়িতে এলেন। পল্লিগ্রামের পাকা ঘুঘু মাছ-ধরায়, সঙ্গে ছ-গাছা ছোটো-বড়ো ছিপ, দু-খানা হুইল লাগানোবাকি সব বিনা হুইলের, টিনে ময়দার চার, কেঁচো, পিঁপড়ের ডিম, তামাক খাওয়ার সরঞ্জাম, আরও কত কী।
মামাকে হেসে বললেন–এলাম বড়োবাবু, আপনাকে বিরক্ত করতে। একটা লোক দিয়ে গোটাকতক কঞ্চি কাটিয়ে যদি দেন–কেঁচোর চার লাগাতে হবে।
মামা জিজ্ঞেস করলেন–এখন বসবেন, না, ওবেলা?
না, এবেলা বসা হবে না। মাছ চারে লাগাতে দু-ঘণ্টা দেরি হবে। ততক্ষণ খাওয়া-দাওয়া সেরে নেওয়া যায়। একটু সকাল-সকাল যদি আহারের ব্যবস্থা …
হ্যাঁ হ্যাঁ, সব হয়ে গেছে। আমিও জানি, আপনি এসেই খেতে বসবার জন্যে তাগাদা দেবেন। মাছ যারা ধরে, তাদের কাছে খাওয়া-টাওয়া কিছুই নয় খুব জানি। আর ঘণ্টা খানেক পরেই জায়গা করে দেব খাওয়ার।
যথাসময়ে হরিশ গাঙ্গুলি খেতে বসলেন এবং একা প্রায় তিনজনের উপযুক্ত খাদ্য উদরসাৎ করলেন।
আমি কলকাতার ছেলে, দেখে তো অবাক।
আমার মামা জিজ্ঞেস করলেনগাঙ্গুলিমশায়, আর একটু পায়েস?
তা একটুখানি না হয়… ওসব তো খেতে পাইনে! একা হাত পুড়িয়ে বেঁধে খাই। বাড়িতে মেয়েমানুষ নেই, বউমারা থাকেন বিদেশে আমার ছেলের কাছে। কে ওসব করে দেবে?
গাঙ্গুলিমশায় কি একাই থাকেন? একাই থাকি বই কী। ছেলেরা কলকাতায় চাকরি করে, আমার শহরে থাকা পোষায় না। তা ছাড়া কিছু নগদ লেন-দেনের কারবারও করি, প্রায় তিনহাজার টাকার ওপর। টাকায় দু আনা মাসে সুদ। আপনার কাছে আর লুকিয়ে কী করব? কাজেই বাড়ি না থাকলে চলে কই? লোকে প্রায়ই আসচে টাকা দিতে-নিতে।
গাঙ্গুলিমশায় এই কথাগুলি যেন বেশ একটু গর্বের সঙ্গে বললেন।
আমি পল্লিগ্রাম সম্বন্ধে তত অভিজ্ঞ না হলেও আমার মনে কেমন একটা অস্বস্তির ভাব দেখা দিলে। টাকাকড়ির কথা এ ভাবে লোকজনের কাছে বলে লাভ কী! বলা নিরাপদও নয়শোভনতা ও রুচির কথা যদি বাদই দিই।
গাঙ্গুলিমশায়কে আমার বেশ লাগল।
মাছ ধরতে ধরতে আমার সঙ্গে তিনি অনেক গল্প করলেন।
… থাকেন তিনি খুব সামান্য ভাবে–কোনো আড়ম্বর নেই–খাওয়া-দাওয়া বিষয়েই কোনো ঝট নেই তাঁর। …এই ধরনের অনেক কথাই হল।
মাছ তিনি ধরলেন বড়ো বড়ো দুটো। ছোটো গোটা-চার-পাঁচ। আমার মামাকে অর্ধেকগুলি দিতে চাইলেন, মামা নিতে চাইলেন না। বললেন–কেন গাঙ্গুলিমশায়? পুকুরে মাছ ধরতে এসেছেন, তার খাজনা নাকি?
গাঙ্গুলিমশায় জিব কেটে বললেনআরে রামো! তাই বলে কী বলচি? রাখুন অন্তত গোটা দুই!
না গাঙ্গুলিমশায়, মাপ করবেন, তা নিতে পারব না। ও নেওয়ার নিয়ম নেই আমাদের।
.
অগত্যা গাঙ্গুলিমশায় চলে গেলেন। আমায় বলে গেলেনতুমি বাবাজি একদিন আমার ওখানে যেও একটা ছুটিতে। তোমার সঙ্গে আলাপ করে বড়ো আনন্দ হল আজ।
কে জানত যে তাঁর বাড়িতে আমাকে অল্পদিনের মধ্যেই যেতে হবে; তবে সম্পূর্ণ অন্য কারণেঅন্য উদ্দেশ্যে।
গাঙ্গুলিমশায়ের সঙ্গে খোশগল্প করার জন্যে নয়।
.
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
গাঙ্গুলিমশায় চলে গেলে আমি মামাকে বললাম–আপনি মাছ নিলেন না কেন? উনি দুঃখিত হলেন নিশ্চয়।
মামা হেসে বললেন–তুমি জান না, নিলেই দুঃখিত হতেন–উনি বড়ো কৃপণ।