- বইয়ের নামঃ দহনকালের শেষে
- লেখকের নামঃ প্রফুল্ল রায়
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
১. স্কুল ছুটির পর
দহনকালের শেষে — উপন্যাস – প্রফুল্ল রায়
০১.
স্কুল ছুটির পর অন্য দিনের মতো সামনের বিশাল গেটটা খুলে দেওয়া হয়েছে। এক ১লহমাও কারও তর সইছিল না। আগে বেরুবার জন্য এখন তুমুল হুড়োহুড়ি, ধাক্কাধাক্কি।
এই নামকরা কো-এড স্কুলটায় ক্লাস ওয়ান থেকে টুয়েলভ পর্যন্ত তেরশোরও বেশি ছাত্রছাত্রী। তারা ঢলের মতো হুড় হুড় করে বেরিয়ে আসছিল। চারপাশ কলরবে মুখর।
ক্লাস চলার সময় বিশাল কমপাউন্ডের ভেতর প্রকাণ্ড দুটো চারতলা বাড়িতে টু শব্দটি শোনা যায় না। এখানে ডিসিপ্লিনের ভীষণ কড়াকড়ি। কিন্তু ছুটির বেল বাজলে তার লেশমাত্র থাকে না। তখন কে কী করল, এই নিয়ে প্রিন্সিপ্যাল আদৌ মাথা ঘামান না।
ভিড়ের ভেতর পথ করে করে ক্লাস টুয়েলভের একটা দঙ্গল বেরিয়ে এসেছিল। বাইরের ফুটপাতে ছেলেমেয়েদের নিয়ে যাবার জন্য অনেক মা, বাবা কি বাড়ির লোক ভিড় করে আছে। রাস্তার ধার ঘেঁষে বিরাট বিরাট স্কুল-বাস দাঁড়ানো। প্রায় ডজন খানেক। সেগুলোর সামনে লম্বা লাইন পড়ে গেছে। তা ছাড়া, একের পর এক আসছে কত না প্রাইভেট কার। মারুতি, ফিয়াট, অ্যামবাসাডর, সান্ত্রো।
রাস্তায় এসে ক্লাস টুয়েলভের সেই দঙ্গলটা ভেঙে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। ইলেভেনে ওঠার পর স্কুল-বাসের সুযোগ নেই। ধরেই নেওয়া হয়, তখন ছাত্রছাত্রীরা যথেষ্ট প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে উঠেছে। নিজেদের যাতায়াতের ব্যবস্থা তাদেরই করে নিতে হয়। অনেকের বাড়ি থেকেই গাড়ি আসে। যারা কাছাকাছি থাকে, হেঁটেই চলে যায়। বাকি সবাই বাস, মিনিবাস কি অটোতে।
টুয়েলভের দুটি মেয়ে–শিঞ্জিনী আর স্বর্ণালী–ডান দিকের ফুটপাত ধরে একটু জোরে জোরেই হাঁটছিল।
গরমের লম্বা ছুটির পর আজই স্কুল খুলেছে। অন্য স্কুলে ভ্যাকেশনের পর প্রথম দিনটা একটু ঢিলেঢালা ভাব থাকে। দু-তিনটে পিরিয়ডের পর ছুটি দেওয়া হয়। কিন্তু এই স্কুল যেদিন খোলে সেদিন থেকেই পুরো ক্লাস।
জুন মাস শেষ হয়ে এল। আবহাওয়া দপ্তরের ঘোষণা অনুযায়ী, এর মধ্যে পুরোদমে বর্ষা নেমে যাবার কথা। কিন্তু সেভাবে আরম্ভই হয়নি। মেঘের আনাগোনা অবশ্য চলছেই। তবে তেমন জমাট বাঁধছে না। মাঝে মাঝে দু-এক পশলা হালকা বৃষ্টি হয়। ব্যস, এই পর্যন্ত।
এখন, এই বিকেলবেলায় পশ্চিম আকাশে বেশ মেঘ জমেছে। রোদের রং মলিন হয়ে যাচ্ছে। তবু ভাবগতিক দেখে মনে হয়, খুব তাড়াতাড়ি বৃষ্টি নামবে না। নামলেও সন্ধের পর।
শিঞ্জিনী আর স্বর্ণালী প্রায় একবয়সি। সতেরো থেকে আঠারোর মধ্যে। দুজনেরই সুশ্রী, ঝকঝকে চেহারা। তবু শিঞ্জিনীই বেশি করে চোখ টানে। সতেরো-পেরুনো এই সদ্য যুবতীর শরীর সবে ভরে উঠেছে। লম্বা ধাঁচের মুখ উজ্জ্বল চোখে গভীর দৃষ্টি। গায়ের রঙে পাকা গমের আভা। মসৃণ ত্বক। ঘন চুল কাঁধ পর্যন্ত ছাঁটা। হাইটও বেশ ভালো। সাড়ে পাঁচ ফিটের কাছাকাছি। হাত-পা-গলা, সব কিছু ক্রমশ নিখুঁত হচ্ছে। তবে একটু লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, মেয়েলি নরম ভাবটা তার মধ্যে কম। কোথায় যেন একটা গোপন রুক্ষতা রয়েছে।
দুজনের পরনে স্কুল ড্রেস। প্লিট-দেওয়া নেভি-ব্ল রঙের হাঁটু ঝুল স্কার্ট আর ধবধবে সাদা জামা। পায়ে কালো জুতো, সাদা মোজা। বুকে-আঁটা পেতলের গোল প্লেটে স্কুলের নামটা মিনে-করা।
স্কুল পেছনে ফেলে ডান পাশে মিনিটখানেক হাঁটলে একটা সরু গলি। গলিটা তিনটে পাক খেয়ে ট্রামরাস্তায় গিয়ে পড়েছে। ওখান থেকে ছুটির পর রোজই বাস বা মিনিবাস ধরে শিঞ্জিনীরা। দুজন একই দিকে থাকে, তবে এক এলাকায় নয়। স্বর্ণালীদের বাড়ি গোলপার্কের পাশে, ফার্ন রোডে। শিঞ্জিনীদের আরও এগিয়ে টিভি সেন্টারের কাছাকাছি।
স্বর্ণালীদের ইমপোর্ট-এক্সপোর্টের বড় বিজনেস। ভারতবর্ষের নানা প্রভিন্সের হ্যাঁন্ডিক্রাফট অর্থাৎ হস্তশিল্পের নানা জিনিস ওরা বিদেশে পাঠায়। জাপান, থাইল্যান্ড এবং ইউরোপের নানা দেশ থেকে কী সব আনিয়ে এখানকার বাজারে বিক্রি করে।
স্বর্ণালীদের অঢেল টাকা। বাড়িতে তিন-চারটে দামি গাড়ি। সাম্রো, সিয়েলো, মারুতি-থাউজেন্ড ইত্যাদি। যে কোনও একটায় সে স্কুলে যাওয়া-আসা করতে পারত। কিন্তু ওর বাবা অন্য ধাতের মানুষ। দেশভাগের পর সর্বস্ব খুইয়ে এপারে চলে এসেছিলেন। কপর্দকশূন্য। প্রথম জীবনে খুব কষ্ট করতে হয়েছে। কটা বছর ভালো করে খাওয়া পর্যন্ত জোটেনি। কিন্তু জেদ ছিল অদম্য, লক্ষ্য অভ্রান্ত। যেভাবে হোক, দাঁড়াতেই হবে। এই কলকাতা শহরে কত মানুষ রাস্তা থেকে উঠে এসে সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছেছে। তিনিই বা পারবেন না কেন? বিপুল পরিশ্রমে ধীরে ধীরে নিজের ভবিষ্যৎ তৈরি করে নিয়েছেন। এখন তাঁর বিরাট ব্যাঙ্ক ব্যালান্স, গাড়ি বাড়ি। ব্যবসাতে লাখ-লাখ টাকা খাটছে। কিন্তু অতীত ভোলেননি। তার দুই মেয়ে–স্বর্ণালী আর তার দিদি সুদীপ্তা। তিনি চান না, মেয়েরা সারাক্ষণ আরামে ডুবে থাকুক। একটু কষ্ট করতে শিখুক ওরা। তাই স্বর্ণালীর স্কুলে বা সুদীপ্তার কলেজে তিনি গাড়ি পাঠান না। ট্রামে-বাসেই গাদানো ভিড়ে ওদের যাতায়াত করতে হয়। এই নিয়ে দুই বোনেরই কোনও ক্ষোভ নেই। নিজেদের গাড়ি এলে হুস করে বাড়ি পৌঁছে যাবে। এখন বরং বন্ধুদের সঙ্গে অনেকটা বেশি সময় কাটানো যায়।