- বইয়ের নামঃ দেরি হয়ে গেছে
- লেখকের নামঃ প্রচেত গুপ্ত
- প্রকাশনাঃ পত্র ভারতী (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
০১. বাইরে চোখ পড়তে
০১.
বাইরে চোখ পড়তে থমকে গেল যামিনী। সামান্য চমকেও উঠল। দেবনাথ রিকশা থেকে নামছে। রিকশা কেন! দেবনাথ তো চট করে রিকশায় ওঠে না। চিন্তিত যামিনী গ্রিলের ওপর ঝুঁকে স্বামীর মুখ দেখতে গেল। পারল না। দেবনাথের মুখ উলটো দিকে ফেরানো।
যামিনীর চিন্তার কারণ আছে। কিছুদিন হল দেবনাথের বাঁ-হাতে একটা ব্যথা শুরু হয়েছে। কনুইয়ের ওপর থেকে মাঝেমধ্যে টানের মতো ধরে। বাজারের ভারী ব্যাগ ধরলে ব্যথা বাড়তে পারে এই ভেবে যামিনী রিকশার কথা বলেছিল। দেবনাথ হেসে উড়িয়ে দেয়।
যামিনী বলল, হাসার কী হয়েছে! ভারী ব্যাগ নিয়ে এতটা পথ হেঁটে আসো তাই রিকশার কথা বললাম। হাতের ব্যথাটা বাড়তে পারে। রিকশা নিলে সময়ও কম লাগবে।
দেবনাথ গম্ভীর গলায় বলল, সময় লাগার জন্যই তো হাঁটি যামিনী। আগে ঘোষবাগানের মধ্যে দিয়ে শর্টকাট করতাম, এখন সেটাও বন্ধ করে দিয়েছি।
সকালবেলা হেঁটে শরীর ভালো করতে চাও তো ঝাড়া হাত পায়ে হাঁটো। কে বারণ করেছে? বাজার-ভরতি ব্যাগ নিয়ে হাঁটার দরকার কী? ব্যথা বাড়লে তো আমাকেই সেবা করতে হবে। রাগ দেখায় যামিনী।
বাজারের ব্যাগ নিয়ে হাঁটারই দরকার আছে। ওই সময়টায় আমি বেগুন, আলু, ঝিঙে পটলের সঙ্গে গল্প করতে করতে আসি। ব্যাগের ভেতর থেকে ওরা আমার সঙ্গে কথা বলে।
যামিনী দেবনাথের দিকে এক ঝলক তাকিয়ে মুখ ফিরিয়ে নেয়।
তাই নাকি! কী বলে ওরা?
দেবনাথ সহজ ভঙ্গিতে বলল, এমন কিছু নয়, হালকা- পলকা কথা সব। দেশের খবর, রাজনীতির খবর জানতে চায়। জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে বলে সেদিন খুব দুশ্চিন্তা করছিল। বলল, স্যার, আপনাদের চারজনের সংসার, কীভাবে যে ম্যানেজ করেন! নেহাত ম্যাডাম স্কুলে পড়ান তাই চলছে। না হলে হালুয়া টাইট হয়ে যেত। সবার অবস্থাই তো দেখছি। আপনার মাইনেটাইনের অবস্থা তো মোটে ভালো নয়। সামনে কোনও প্রোমোশন আছে বলেও মনে হচ্ছে না। শুনেছি ইউনিয়নকে তেল মারতে পারেন না, প্রোমোশন হবে কী করে! যাক, ম্যাডামকে সাবধানে চলতে বলবেন। ওঁর আবার খরচাপাতির হাত বেশি। এরকম করলে চলবে না, টেনে চলতে হবে। ছেলেমেয়ে দুটো এখন ছোট বলে চলে যাচ্ছে, বড় হলে চাপ বাড়বে। দিনকাল ভালো নয়।
যামিনী চোখ বড় করে, গলায় মেকি বিস্ময় ফুটিয়ে বলল, তোমার ঝিঙে-পটলরা তোমাকে জ্ঞানও দেয়? বাপরে! এ তো শিক্ষিত ঝিঙে পটল দেখছি!
দেবনাথ গলায় আবেগ এনে বলল, জ্ঞান বলছ কেন যামিনী? অ্যাডভাইস বলো। বন্ধুকে বন্ধুর অ্যাডভাইস।
যামিনী আর পারে না, হেসে ফেলে। বলল, থাক, তোমাকে রিকশা চাপতে হবে না, তুমি হেঁটেই এসো। আমার বলাটাই অন্যায় হয়েছে। তোমার ঝিঙে-পটল রাগ করবে।
দেবনাথের রসিকতার স্বভাব যামিনী গোড়া থেকেই চিনেছে। বিয়ের সময় থেকেই। ফুলশয্যার রাতে এই লোক তাকে ফিসফিস করে বলেছিল, একটা গোপন কথা আছে। যদি কখনও ফাস না করে বলতে পারি। এই কথা আমি কাউকে বলিনি।
সম্বন্ধ করে বিয়ে। মানুষটার সঙ্গে আলাপ-পরিচয় মাত্র কয়েকদিনের। কথা হয়েছে মেরেকেটে পাঁচদিন। তা-ও তিনদিন টেলিফোনে, দুদিন মুখোমুখি। সেই মুখোমুখির আবার ভাগ ছিল। প্রথমদিন সঙ্গে বাড়ির লোক ছিল। ছেলের বউদি। দ্বিতীয়দিন দুজনে একা একা। ফলে চেনা হয়নি প্রায় কিছুই। তার ওপর ফুলশয্যা-রাতের আড়ষ্টতা। যামিনী কথা না বলে শুধু চোখ তুলেছিল। একটু ভয়ও পেয়েছিল। গোপন কথা আবার কী রে বাপু! অসুখবিসুখ আছে নাকি? মালবিকার এরকম হয়েছিল। ফুলশয্যার রাতে ছেলে দরজা বন্ধ করেই কান্নাকাটি শুরু করল– আমি পারি না, আমার অসুখ আছে। আমায় তুমি ক্ষমা করে দাও। এ-ও সেরকম নয় তো! পুরোনো প্রেম? গল্প-উপন্যাসে এরকম পড়েছে। এইসব সময় নতুন স্বামী দুম করে অন্য মেয়ের গল্প বলে বসে। প্রথম প্রেমে ব্যথা পাওয়ার গল্প। হাত চেপে ধরে যাত্রামার্কা থরথর গলায় বলে, তুমি কিন্তু একাজ করো না, তা হলে আমি মরে যাব সোনা।
দেবনাথ সে সব কিছুই বলল না। স্মার্ট ভঙ্গিতে সরাসরি প্রশ্ন করল, আমি তোমাকে কেন বিয়ে করলাম জানো যামিনী?
যামিনী চুপ করে রইল। একথার সে কী উত্তর দেবে? ফুলশয্যার পরীক্ষায় যাতে মোটামুটি পাস করতে পারে তার জন্য বন্ধুদের কাছ থেকে কিছু প্রশ্নের উত্তর শিখে এসেছে। থিওরিটিক্যাল, প্র্যাকটিকাল দুটোই। তাতে এই প্রশ্ন ছিল না। তবু লাজুক গলায় বলল, পছন্দ হয়েছে তাই।
দেবনাথ ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলল। হাতটা মাথার পিছনে রেখে বালিশে শুয়ে পড়ল ধপাস করে। তারপর সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে উদাসীন গলায় বলল, অনেকে ভাববে সুন্দরী এবং ভালো মেয়ে বলে তোমাকে আমার পছন্দ হয়েছে। কথাটা ঠিক নয়। আমি একবারই মেয়ে। দেখতে গেছি, আর সেটা তোমাকেই। ফাস্ট অ্যান্ড ফাইনাল। তুমি যদি এটা শুনে খুশি হও, তা হলে বিরাট বোকামি করবে। কিছু মনে কোরো না, তোমার বদলে সেদিন যদি অন্য কাউকে দেখতে যেতাম, তা হলেও রাজি হয়ে যেতাম। আমার পক্ষে আর দেরি করা সম্ভব ছিল না। কারণ আমি বিয়ে করেছি বউয়ের জন্য নয়, ভূতের জন্য!