- বইয়ের নামঃ পাঁচকড়ি রচনাবলী – ২য় খণ্ড
- লেখকের নামঃ পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়
- বিভাগসমূহঃ প্রবন্ধ
পঞ্চ ‘ম’কার
মদ্য, মাংস, মৎস্য, মুদ্রা ও মৈথুন–ইহাই তন্ত্রসাধনার পঞ্চ মকার বা পঞ্চ তত্ত্ব। শ্লীলবাদী বাবুরা জিজ্ঞাসা করিয়া থাকেন যে, এই পঞ্চ তত্ত্বের কি কোন আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা আছে, কোন esoteric অর্থ আছে, না উহা সোজাসুজি সাধারণ ভাবে বুঝিতে হইবে? এই জিজ্ঞাসার সহিত এটুকু ইঙ্গিতও করা হয়, যেন সোজা অর্থে উহা বেজায় মন্দ, ধৰ্ম্মের নামে পাপের প্রশ্রয় দেওয়া হয়, উহা Black Art বা কালা বিদ্যা, বামমার্গ বা সজ্জন-সমাজের হেয় ব্যাপার। তন্ত্রগ্রন্থসকল পাঠ করিয়া আমাদের যাহা ধারণা হইয়াছে, তাহাতে ত আমরা বুঝি–পঞ্চ তত্ত্বের তিন প্রকারের প্রয়োগ আছে। (১) এক, মোটামুটি সোজাসুজি অর্থ; মদ্য, মাংস, মৎস্য, মুদ্রা ও মৈথুন বাহ্য পূজায় এবং স্কুল সাধনায় উহার নিয়মিত প্রয়োগ আছে; (২) মানস পূজায় উহার অর্থ স্বতন্ত্র নহে, তবে তাহা কাল্পনিক ব্যাপার মাত্র; মনে মনে কল্পনা করিতে হইবে যে, আমি সাধক দেবীকে সুরার সাগর, মাংসের পর্বত, মৎস্যের স্তৃপ, মুদ্রার সম্ভার দিতেছি এবং পদ্মিনী নারীর সহিত মৈথুন সাহায্যে কুণ্ডলিনীকে জাগরিতা করিতেছি; (৩) ষট্চক্রভেদে পঞ্চ তত্ত্বের অর্থ স্বতন্ত্র, প্রয়োগও স্বতন্ত্র, সেখানে উহার আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা বা ইসটরিক অর্থ আছে। কিন্তু তন্ত্রের পদ্ধতিমত ষট্চক্ৰভেদ কয় জন করিতে পারে? কয় জন বাহিরের শক্তির সহায়তা ব্যতিরেকে কুণ্ডলিনীর উদ্বোধন ঘটাইতে পারে? পারে না-সচরাচর হয় না বলিয়াই উহার সোজা অর্থ ধরিতে হয়, সাধারণতঃ লোকে পঞ্চ মাকারে যাহা বুঝে, তাহাই ধরিয়া লইতে হয়। কিন্তু জিজ্ঞাসা করি, ইহাতে লজার বা সঙ্কোচের বিষয় কি আছে? তন্ত্রধৰ্ম্ম প্রচারের ধৰ্ম্ম নহে, উহা গুপ্ত—গোপ্য সাধনার ধৰ্ম্ম; যাহার যেমন শক্তি, যাহার যেমন অধিকার, তাহাকে তেমনই কৰ্ম্মপদ্ধতি দেখাইয়া দিয়া তন্ত্র, জীবমাত্রেরই উদ্ধারের পথ প্রশস্ত করিয়া দিয়াছেন। তন্ত্র ভাবের ঘরে চুরি করে না, ভিতরের পর্দা ও বাহিরের পর্দা রাখে না; তুমি যেমন, তোমার প্রবৃত্তি যেমন, তেমনই সাধনপদ্ধতির ব্যবস্থা করিয়া থাকে। সুতরাং পঞ্চ মাকারে লজাবোধ করিবার ত কোন হেতু দেখি না।
পূর্বেই বলিয়া রাখিয়াছি যে, আত্মশক্তি, উম্মেষ সাধনই তন্ত্রসাধনা। তন্ত্র নিজের দেহস্থ আত্মা ছাড়া অন্য কোন বাস্থ শক্তিকে দেবতা, ঈশ্বর বলিয়া মানে না। তন্ত্র বলেন যে, আমার দেহমধ্যে যে এক জন বিরাজ করিতেছেন, তাহা আমি বুঝি; তিনি জগৎকে বুঝিতে চাহেন, সৃষ্টিপ্ৰহেলিকাকে উদঘাটন করিতে চাহেন। তাই অনুমান করিতে হয় যে, যিনি আমার ভিতরে আছেন, তিনিই বিশ্বসৃষ্টির মধ্যে আছেন। আমার ভিতরের ঠাকুরকে আমি চিনিতে পারিলে বাহিরের ঠাকুরটি আপনি আসিয়া ধরা দিবেন। এখন দেখিতে হইবে, আমার ভিতরের ঠাকুরের বিকাশ কেমন করিয়া হয়। আহারে বিহারে, জীবনের উপভোগে ভিতরের ঠাকুরটি যেন একটু জাগিয়া উঠেন। বিশেষতঃ কাম ও মদনের চেষ্টায় ভিতরের ঠাকুরের যেন কতকটা নাগাল পাওয়া যায়; কারণ, কামচৰ্চার ফলে নরনারীর সংযোগে একটা নূতন জীবের সৃষ্টি হইতেছে। অতএব মৈথুন হইতেই কুণ্ডলিনীর জাগরণের পদ্ধতি অনেকটা বুঝা যায়। তন্ত্র স্পষ্ট বলিয়াছেন, সিস্মৃক্ষ বা সৃজন ইচ্ছা কামের নামান্তর মাত্র। যে পরমাত্মা ‘এক আমি বহু হইব’ বলিয়া সৃষ্টিপ্ৰহেলিকার বিকাশ করিয়াছিলেন, সেই পরমাত্মা তোমার দেহস্থ থাকিয়া এক আমি বহু হইবার সাধ অন্য নারীতে উপগত হইয়া মিটাইয়া থাকে। অ্যাদি সৃষ্টিতে যেমন আদ্যা শক্তির জাগরণের ফলে বিশ্বাত্মার মনে সিস্বাক্ষা জাগিয়া উঠিয়াছিল, তেমনই নারীদেহাভ্যন্তরে আদ্যা শক্তি কুণ্ডলিনী জাগিয়া উঠিলে, তবে সে নারী পুরুষকে আকর্ষণ করে এবং সেই আকর্ষণের ফলে, স্ত্রীত্ব-পুত্বের সংযোগে নূতন জীবসৃষ্টি হয়। কুণ্ডলিনী না জাগিলে কোন স্ত্রীই গর্ভবতী হইতে পাৱে না, কুণ্ডলিনী না জাগিলে কোন পুরুষের রেতঃপ্রবাহের সহিত আত্মশক্তির নিঃসরণ হয় না, নারীর জরায়ুতে নব জীবের আধান হয় না। অতএব প্রকৃত মৈথুনপদ্ধতির বিশ্লেষণ করিতে পারিলে আত্মশক্তির কতকটা পরিচয় পাওয়া যায়।
ইহাই হইল তন্ত্রের সৃষ্টিতত্ত্বের থিওরি বা সিদ্ধান্তকথা। একা তন্ত্র কেন—উপনিষদে, পুরাণে, বৈষ্ণব শৈব সকল শাস্ত্রে এই একই সিদ্ধান্ত নানা ভাবে, নানাপ্রকারের ভাষায় বর্ণিত আছে। অন্য সকল শাস্ত্ৰ যাহা থিওরির হিসাবে ব্যাখ্যা করিয়া নিরস্ত আছেন, তন্ত্র তাহাকে করিয়া কৰ্ম্মিয় দেখাইয়া দিয়াছে। এইখানে একটা কথা বলিব। আমাদের দেশে কতকটা হঠযোগের প্রভাবে, কতকটা খ্ৰীষ্টানধৰ্ম্মের প্রভাবে নারী বা স্ত্রীজাতি সমাজে যেন একটু নিম্ন স্থান অধিকার করিয়াছেন। অথচ বেদ হইতে পুরাণ তন্ত্ৰ পৰ্য্যন্ত সকল ঋষিপ্রণীত শাস্ত্রই বার বার বলিয়া রাখিয়াছে যে, নারী নরের অৰ্দ্ধাঙ্গস্বরূপিণী, ধৰ্ম্মকৰ্ম্মের সহচরী! বেদের কোন যজ্ঞই পত্নী ব্যতীত হইবার জো নাই; অগ্নিহোত্ৰী হইতে হইলে পত্নী চাহি। পৌরাণিক ক্রিয়াকৰ্ম্ম পত্নীর সহিত করিতে হয়; পত্নীসঙ্গবৰ্জিত হইয়া তীর্থদর্শন করিলে সে দর্শন ব্যর্থ হয়; শ্ৰাদ্ধ শান্তিও পত্নী সহ করিতে হয়। শক্তিশূন্য হইয়া কোন যজ্ঞ করিবার উপায় নাই। দীক্ষা গ্ৰহণ করিতে হইলে পতি পত্নী একসঙ্গে লইতে হইবে; জপ যজ্ঞ করিতে হইলে পতি পত্নী একসঙ্গে করিতে হইবে; মহানির্বাণতন্ত্র স্পষ্টই বলিয়াছেন যে, ভৈরবীচক্ৰে পত্নীকে শক্তিরূপে পাইলে অন্য নারীর প্রয়োজন হয় না। অন্য নারীকে শক্তি করিতে হইলে শৈব পদ্ধতিমতে তাহাকে বিবাহ করিয়া, পত্নীর পদে বরণ করিয়া, তবে চক্ৰে বসিতে হইবে। যাহার পত্নী নাই, তাহার কোন বৈধ কৰ্ম্মে অধিকার নাই; সে গৃহস্থাশ্রমে থাকিতেই পারে না। তাহাকে হয় প্ৰব্ৰাজ্য গ্ৰহণ করিতে হইবে, নহিলে বানপ্ৰস্থ অবলম্বন করিতে হইবে। গৃহস্থাশ্রমে থাকিতে হইলে বিপত্নীক পুরুষকে বিবাহ করিতেই হইবে। অবশ্য যদি কোন গৃহীর পঞ্চাশ বৎসর বয়স অতিক্রান্ত হইলে স্ত্রীবিয়োগ হয়, তাহা হইলে তিনি ইচ্ছা করিলে বানপ্ৰস্থ আশ্রম অবলম্বন করিতে পারেন। কিন্তু গৃহী কািন্ত্রী থাকিতে হইলে তাঁহাকে শৈব মতে বিবাহ করিয়া ঘর সংসার চালাইতে হইবে। ইহাই তন্ত্রের আদেশ। শঙ্করাচাৰ্য্য নারীকে নরকের দ্বার বলিয়াছেন, এই হেতু ব্ৰহ্মানন্দ গিরি শঙ্করাচাৰ্যকে খুব একহাত তিরস্কার কুরিয়াছেন। তন্ত্রমতে নারীই আদ্যাশক্তিস্বরূপিণী—জগন্ময়ী—জগজ্জননী; সুতরাং নারী পূজনীয়া, অৰ্চনীয়া, সাদরে রক্ষণীয়া। খ্ৰীষ্টানধৰ্ম্মে নারীকে শয়তানের প্রলুব্ধ জীব বলিয়া নির্দেশ করা হইয়াছে। খ্ৰীষ্টানধৰ্ম্ম অনুসারে নারীসঙ্গ শয়তানের প্ররোচনায় হইয়া থাকে। অতএব মেয়েমানুষ ও মৈথুন খ্ৰীষ্টানধৰ্ম্মের সিদ্ধান্ত অনুসারে মহাপাপজ। মনীষী শ্ৰীযুত রামেন্দ্রসুন্দর ত্ৰিবেদী বলেন যে, খ্ৰীষ্টানধৰ্ম্মের এবং হঠযোগী নিষ্কামধৰ্ম্মীদিগের নারীর প্ৰতি এই বিতৃষ্ণার ভাব গোড়াকার বৌদ্ধধৰ্ম্মের প্রভাবেই ঘটিয়াছিল। আমরা এ সিদ্ধান্ত অমান্য করিতে পারি না। কিন্তু মজা এই, যে ধৰ্ম্ম বা সাধনপদ্ধতিতে নারীর অত্যন্ত নিন্দা আছে, সেই ধর্মের ধাৰ্ম্মিকগণ পরে লাম্পট্যদোষে দুষ্ট হইয়া অধঃপাতে গিয়াছে। বৌদ্ধ ধর্মের অধঃপতন লাম্পট্যদোষেই ঘটিয়াছিল; খ্ৰীষ্টানধৰ্ম্মের অধঃপতনও ঐ লাম্পট্যদোষেই ঘটে। পরে প্রটেষ্টাণ্ট ধৰ্ম্মের প্রচার হইলে খ্ৰীষ্টান ইউরোপ একটু সামলাইয়াছিল বটে, পরন্তু আবার বর্তমান বিলাসপ্রধান সভ্যতার দংশনে আধুনিক ইউরোপে লাম্পট্যের অতিবিস্তার ঘটিয়াছিল। এখন যে ভয়ানক যুদ্ধ চলিতেছে, তাহার পরিণামে ইউরোপের লাম্পট্যদোষের কতকটা সংবরণ হইতে পারে।