- বইয়ের নামঃ মায়াবিনী
- লেখকের নামঃ পাঁচকড়ি দে
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
০১. নারী না পরী – প্রথম খণ্ড
মায়াবিনী
প্রথম খণ্ড – নারী না পরী
প্রথম পরিচ্ছেদ – নূতন সংবাদ
একদিন অতি প্রত্যুষে দেবেন্দ্রবিজয় স্থানীয় থানায় আসিয়া ইনস্পেক্টর রামকৃষ্ণ বাবুর সহিত দেখা করিলেন।
যাঁহারা আমার “মনোরমা” নামক উপন্যাস পাঠ করিয়া আমাকে অনুগৃহীত করিয়াছেন, তাঁহাদিগকে দেবেন্দ্রবিজয় মিত্রের পরিচয় আর নূতন করিয়া দিতে হইবে না। যে সময়কার ঘটনা বলিতেছি, তখনকার ইনি একজন সুপ্রসিদ্ধ, সুদক্ষ ও শ্রেষ্ঠ ডিটেক্টিভ। তাঁহার ভয়ে তখন অনেক চোর চুরি ছাড়িয়াছিল, অনেক ডাকাত ডাকাতি ছাড়িয়াছিল, অনেক জালিয়াৎ জালিয়াতী ছাড়িয়াছিল; স্ব স্ব ব্যবসায়ে এরূপ একটা অপরিহার্য্য ব্যাঘাত ঘটায় সকলে কায়মনোবাক্যে অহর্নিশ ইষ্টদেবতার নিকটে দেবেন্দ্রবিজয়ের মরণ আকাঙ্খা করিত। সকলেই ভয় করিত; ভয় করিত না—গর্বিত জুমেলিয়া। সে ইষ্টদেবতার নিস্ফলসহায়তার প্রতি উপেক্ষা প্রদর্শন করিয়া, সেই সময়ে স্বহস্তে দেবেন্দ্রবিজয়কে খুন করিবার জন্য ‘মরিয়া’ হইয়া উঠিয়াছিল। সে তাঁহাকে আন্তরিক ঘৃণা করিত। দেবেন্দ্রবিজয় যদি তেমন একজন ক্ষমতাবান, বুদ্ধিমান লোক না হইয়া একটি ক্ষুদ্র পিপীলিকা হইতেন, তাহা হইলে সে তাঁহাকে পদতলে দলিত করিয়া মনের সাধ মিটাইতে পারিত। তা’ না হইয়। দেবেন্দ্র কি না প্রতিবারেই তাহাকে হতদর্প করিল—ছিঃ—ছিঃ—ধিক্ ধিক্; এই সব ভাবিয়া জুমেলিয়া আরও আকুল হইয়া উঠিত। এই বর্তমান আখ্যায়িকা পাঠ করিবার পূৰ্ব্বে পাঠকের ‘মনোরমা’ নামক পুস্তকখানি পাঠ করিলে ভাল হয়; এখানিকে মনোরমা পুস্তকের পরিশিষ্ট বলিলেও চলে।
যখন দেবেন্দ্রবিজয় রামকৃষ্ণ বাবুর সহিত দেখা করিলেন, তখন তিনি নিশ্চিন্তমনে বাঁশের সংক্ষিপ্ত সংস্করণের ন্যায় একটি চুরুট দন্তে চাপিয়া ধুমপান করিতেছিলেন; তেমনি পরম নিশ্চিন্তমনে দেখিতেছিলেন, সেই ধূমগুলি কেমন কুণ্ডলীকৃত হইয়া, উন্মুক্ত বাতায়ন পথ দিয়া, দল বাধিয়া বাহির হইয়া যাইতেছিল। তেমন প্রত্যুষে দেবেন্দ্রবিজয়কে সহস৷ সেই কক্ষমধ্যে প্রবিষ্ট হইতে দেখিয়া তিনি কিছু বিস্মিত হইলেন। সসম্মানে তাহাকে নিজের পার্শ্বস্থিত চেয়ারে বসাইয়া বলিলেন, “কি হে, ব্যাপার কি? আমাকে দরকার না কি? এত সকালে যে?”
দেবেন্দ্রবিজয় কহিলেন, “ব্যাপার বড় আশ্চৰ্য্য; শুনলেই বুঝতে পারবে, ব্যাপারটা কতদূর অলৌকিক; তেমন অলৌকিক ঘটনা কেউ কখনও দেখে নাই—শুনে নাই।”
রাম। এমন কি ঘটনা হে?
দেবেন্দ্র। বড়ই অলৌকিক—একেবারে ভৌতিক-কাণ্ড–তুমি শুনলে তোমারও বিস্ময়ের সীমা থাকবে না।
রাম। বেশ, আমিও বিস্মিত হইতে চাই। প্রায় দশ বৎসরের মধ্যে আমি একবারও বিস্ময়ান্বিত হইয়াছি কি না সন্দেহ; তোমার কথায় যদি এখন তা ঘটে, সে বিস্ময়টায় কিছু-না-কিছু নূতনত্ব আছেই।
দেবেন্দ্র। ফুলসাহেবকে তোমার স্মরণ আছে?
রাম। বিলক্ষণ!
দেবেন্দ্র। জুমেলিয়াকে? যে এতদিন জাল-মনোরমা সেজে নিজের বাহাদুরী দেখাইতেছিল, শেষে হাজরার বাগান-বাড়ীতে আত্মহত্য করে, তাকে স্মরণ আছে কি?
রাম। হা, সেই পিশাচী ত?
দেবেন্দ্র। সত্যই সে পিশাচী বটে!
রাম। তার কি হয়েছে?
দেবেন্দ্র। তার মৃত্যুর বিবরণটা কি এখন তোমার বেশ স্মরণ আছে?
রাম। বেশ আছে!
দে। জুমেলিয়ার দেহ যতক্ষণ না কবরস্থ করা হয়েছিল, ততক্ষণ আমি তৎপ্রতি সতর্ক-দৃষ্টি রেখেছিলাম ব’লে, তুমি আর কালীঘাটের থানার ইনস্পেক্টর হেসেই অস্থির।
রাম। শুধু কবরস্থ নয়—সেই শবদেহ কবরস্থ ক’রে কবর-স্মৃত্তিক পূর্ণ করা পৰ্য্যন্ত তোমার সতর্ক দৃষ্টি সমভাবে ছিল। ইহা ত হাসিবারই কথা, দেবেন্দ্র বাবু! [ হাস্য ]
দেবেন্দ্র। এখন সেই ঘটনা, আমার সে সতর্কতা যে বৃথা নয়, তা’ প্রমাণ করেছে। তবু যতদুর সতর্ক হওয়া আবশ্যক, তা আমি হ’তে পারি নি; আরও কিছুদিন সেই কবরের প্রতি বিশেষ দৃষ্টি রাখাই আমার উচিত ছিল।
রা। অ্যাঁ—বল কি হে! তোমার মাথাটা নিতান্ত বিগড়াইয়। গিয়াছে দেখছি। কবরের উপর এত সাবধানত কেন? তার পর তুমি জুমেলিয়ার কবরের উপর আর পাহারী দিয়াছিলে কি?
লে। হ্যাঁ, এক সপ্তাহ।
রা। যে লোক ম’রে গেছে—যাকে পাঁচ হাত মাটির নীচে কবর দেওয়া হয়েছে—তার উপর তুমি এক সপ্তাহ নজর রেখেছ; এখনও আবার বল্ছ যে, আরও কিছুদিন নজর রাখতে পারলে ভাল হ’ত, –এ সব কথার অর্থ কি? মাটির নীচে—এক সপ্তাহ—তবু যে কোন মানুষ বাঁচতে পারে, তা আমার বুদ্ধির অগম্য।
দে। তা’ মিথ্যা বল নাই, এরূপ স্থলে সাধারণ লোকের পক্ষে জীবিত থাকা অসম্ভব।
রা। দেবেন্দ্র বাবু, মৃত্যুর কাছে আবার সাধারণ আর অসাধারণ কি?
দে। তুমি কি আরবদেশের ফকিরদিগের এরূপ পুনরুখান সংক্রান্ত কোন ঘটনার কথা কখনও শোন নাই?
রা। অনেক সময়ে অনেক শুনেছি।
দে। তারা কি করে জান?
রা। হ্যাঁ, কিছু কিছু।
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
দেবেন্দ্রবিজয় বলিতে লাগিলেন, “আরবদেশের ফকিরের দ্রব্যগুণ প্রক্রিয়ায় আপনাদিগকে এমন নিম্পন্দন নিশ্চেতন করে যে, বড় বড় ডাক্তারের বিশেষ পরীক্ষায় জীবনের কোন চিহ্নই বাহির করিতে পারে না। তার পর সকলের সম্মুখে সেই ফকিরকে সমাধিস্থ করা হয়। ফকির ইতিপূৰ্ব্বে এমন একজন চেলা ঠিক ক’রে রাখে যে, ফকিরের স্থিরীকৃত দিবসাবধি—সম্ভবতঃ একমাস সেই কবরের উপর সতত দৃষ্টি রাগে। তার পর নির্দিষ্ট দিনে ফকিরের পুনরুত্থান হয়। পরক্ষণেই সেই ফকিরের মৃতকল্প দেহে চৈতন্তচিহ্ন প্রকাশ পায়; তার পর সে ওঠে, বসে, কথা কহে, স্বচ্ছন্দচিত্তে এদিকে ওদিকে বেড়াইতে পারে; মোট কথা—সে পূৰ্ব্বে যেমন ছিল, ঠিক তেমনই হইয় উঠে।”
রা। [ সহাস্তে ] যাদের সমক্ষে এ কাও হয়, তারা গাধা।
দে। আমাকেও কি ‘গাধা’ ব’লে তোমার বিবেচনা হয়?
রা। না |
দে। না কেন? আমিই স্বচক্ষে এমন কাগু অনেক দেখেছি; আমি এ ঘটনা অন্তরের সহিত বিশ্বাস করি; এ ঘটনা অসম্ভব নয়।
রা। বেশ, এখন ব্যাপার কি বল? তোমার সুদীর্ঘ গৌরচন্দ্রিক যে আর ফুরায় না!
দে। ডাক্তার ফুলসাহেব অনেক দিন আরবদেশে ছিল; তার পর কামরূপ ঘুরে আসে। সে নানা প্রকার দ্রব্যগুণ ও মন্ত্রাদি জানত— তার অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল।
র: তা’ সে সকলকে প্রচুর পরিমাণে দেখিয়ে মরেছে।
দে। জুমেলিয়া তারই ছাত্রী—শুধু ছাত্রী নয়, স্ত্রী।
রা। হ্যাঁ জানি, জুমেলিয়া বড় সহজ মেয়ে ছিল না।
দে। শিক্ষকের চেয়ে ছাত্রীর শিক্ষা আরও বেশি।
রা। হ’তে পারে, কি হয়েছে তা’?
দে। জুমেলিয়া—সেই নারী-পিশাচী এখনও মরে নি।
রা। [ সবিস্ময়ে ] বল কি হে!
দে। আমি সেই কথাই তোমাকে বলতে এসেছি। যদি সে বেঁচে থাকে, অবশ্যই তুমি শীঘ্রই তা জানতে পারবে। সে বড় সহজ স্ত্রীলোক নয়, নিজের হাতে সে অসংখ্য নরহত্যা করেছে। সে এখন জীবিত কি মৃত, তুমি তার কবর খুঁড়ে দেখলেই জানতে পারবে।
রা। কতদিন তাকে গোর দেওয়া হয়েছে?
দে। আজ বৈকালে ঠিক উনচল্লিশ দিন পূর্ণ হবে।
রা। না না; যে মৃতদেহ এতদিন গোরের ভিতর রয়েছে—তা’ আবার টেনে বের করা যুক্তিসিদ্ধ ব’লে বিবেচনা করি না।
দে। মৃতদেহ! মৃতদেহ পাবে কোথায় তুমি? দেখবে কবর শূন্য প’ড়ে আছে।
রা। এ খেয়াল বোধ হয়, তোমার সম্প্রতি হ’য়ে থাকবে।
দে। হ্যাঁ, সম্প্রতি।
রা। দেবেন্দ্র বাবু, ব্যাপারটা কি হয়েছে বল দেখি?
দে ৷ শ্ৰীশচন্দ্র নামে একটি চতুর ছোকরা আমার কাছে শিক্ষানবীশ আছে। “১৭—ক” পুলিন্দার কেসে সে আমার অনেক সহায়তা করেছে। যে গোরস্থানে” জুমেলিয়াকে গোর দেওয়া হয়েছে, সেই গোরস্থানে কাল শ্ৰীশচন্দ্র বেড়াতে যায়। ফিরে আসার সময়ে জুমেলিয়ার কবর দেখতে যায়। জুমেলিয়া তাকে যেরূপ বিপদে ফেলেছিল, তাতে সে জুমেলিয়াকে কখনও ভুলতে পারবে বলে বোধ হয় না। শ্ৰীশচন্দ্রের যদিও বয়স বেশি নয়, বেশ চতুর বটে—আর দৃষ্টিটাও যে বেশ তীক্ষ্ণ আছে, এ কথা স্বীকার করা যায়। জুমেলিয়ার কবরটার উপরকার মার্টিগুলো আলগা আলগা দেখে তার মনে কেমন একটা সন্দেহ হয়; তার পর সে এক টুক্রা কাগজ সেইখানে কুড়িয়ে পায়; তাতে তার সেই সন্দেহ বদ্ধমূল হয়। সেই কাগজ টুক্রায় জুমেলিয়ার, নাম লেখা ছিল। তার পর সে অপর টুকরাগুলির সন্ধান করতে লাগল; সেইরূপ ছোট ছোট টুক্রা কাগজ চারিদিকে অনেক ছড়ান রয়েছে দেখতে পেলে। সেদিন সে কেবল সেই কাগজ টুকরাগুলি বেছে বেছে সংগ্ৰহ ক’রে বাড়ী ফিরে আসে। সে আমাকেও সকল কথা তখন কিছুই বলে নাই, নিজেই সে সেই ছোট ছোট কাগজগুলি ঠিক ক’রে সাজিয়ে আর একখানা কাগজে গদ দিয়ে জুড়ে রাখে।
রা। শ্ৰীশচন্দ্র টুক্রা কাগজগুলো ঠিক সাজাতে পেরেছিল?
দে। পেরেছিল।
রা। কেমন লোকের ছাত্ৰ! ভাল, তার পর?
দে। কাল রাত্রে আমার হাতে সে সেই পত্ৰখানা এনে দেয়, তেমন আশ্চৰ্য্য পত্র আমি কখনও দেখি নাই।
রা। কিরূপ আশ্চৰ্য্য শুনতে পাই না কি?
দে। আমার কাছেই আছে, শ্ৰীশ সেই ছিন্নপত্ৰখানা বেশ পাঠোপযোগী ক’রেই আমার হাতে দিয়েছে। আগেকার টুকরাগুলি পাওয়ার যায় নাই; মধ্যেরও দু-এক টুকরা পাওয়া যায় নাই। শ্ৰীশ নিজে সেই-সেইখানে কথার ভাবে আন্দাজ ক’রে ঠিক কথাগুলিই বসিয়েছে; প’ড়ে দেখ। [ পত্র প্রদান ]