- বইয়ের নামঃ রতিবিলাপ
- লেখকের নামঃ নীহাররঞ্জন গুপ্ত
- বিভাগসমূহঃ গোয়েন্দা কাহিনী
০১-০৫. মেয়েটির মুখের দিকে চেয়ে
রতিবিলাপ
মুখবন্ধ
কিছুদিন ধরেই লক্ষ্য করছিলাম পুলিসের বড়কর্তা মিঃ সেন রায় ঘন ঘন কিরীটীর কাছে যাতায়াত করছিলেন।
একদিন কৌতূহলটা আর দমন করতে না পেরে শুধালাম, কি ব্যাপার রে কিরীটী?
কিরীটী আনমনে একটা জুয়েলস সম্পর্কিত ইংরাজী বইয়ের পাতা ওল্টাচ্ছিল সামনের সোফাটার উপর বসে—মুখ না তুলেই বললে, কিসের কি?
সেন রায় সাহেবের এত ঘন ঘন যাতায়াত কেন তাই শুধাচ্ছিলাম।
কিরীটী মৃদু হেসে বলে, ক্ষ্যাপা খুঁজে ফেরে পরশপাথর।
পরশপাথর!
হ্যাঁ, কিছুদিন যাবৎ কলকাতা শহরে ইমিটেশন জুয়েলস নকল জহরতের সব ছড়াছড়ি দেখা যাচ্ছে।
নকল জহরৎ!
হ্যাঁ, তাই ভদ্রলোকের আহার নিদ্রা সব ঘুচে গিয়েছে।
তা ভদ্রলোকের কোন সুরাহা হল?
কোথায় আর হল?
তবে আজ যে সেন রায়কে ইকনমিক জুয়েলার্সের রাঘব সরকারের কথা কি বলছিলি?
কলকাতা শহরে জুয়েলসের মার্কেট তো ঐ ইকনমিক জুয়েলার্সের রাঘব সরকারই কনট্রোল করছে। তাই বলছিলাম ওদিকটায় একবার খোঁজ নিতে।
মৃদু হেসে বললাম, কেবল কি তাই?
তাছাড়া আর কি! বঁড়শী ফেলে রুই কাতলাই ধরা উচিত—পুঁটি ধরে কি হবে!
ঐ ঘটনারই দিন দুই পরে—
.
০১.
মেয়েটির মুখের দিকে চেয়ে চেয়ে দেখছিলাম। মুখের মধ্যে কোথায় যেন একটু বিশেষত্ব আছে। এবং নিজের অজ্ঞাতেই বোধ হয় মুখটির মধ্যে কোথায় এবং কেন বিশেষত্ব সেইটাই অনুসন্ধান করছিলাম।
মনে হচ্ছিল যাকে বলে তীক্ষ্ণ বুদ্ধিশালিনী না হলেও মনের মধ্যে যেন তার একটা বিশেষ অনুভূতি আছে, যে অনুভূতি অনেক কিছুরই ইশারা দেয় বুঝি।
তবে সেদিন মেয়েটি চলে যাবার পর কিরীটী এক সময় বলেছিল মেয়েটি সম্পর্কে আমার অভিমত শুনে, মিথ্যে নয়, ঠিকই ধরেছিস। তবে সেই অনুভূতিকে যেন আচ্ছন্ন করে রেখেছিল একটা আশংকার কালো ছায়া।
সত্যি বলছিস?
সত্যি।
তবে ওকথা মেয়েটিকে বললি কেন?
কিরীটী মৃদু হেসে প্রত্যুত্তর দিয়েছিল, মেয়েটির চেষ্টাকৃত ভণিতা দেখে।
ভণিতা?
কিন্তু ঐ পর্যন্তই। কিরীটী আর কোন কথা বলেনি বা বলতে চায়নি।
.
মাত্র হাত দুই ব্যবধানে আমাদের মুখোমুখি বসেছিল অন্য একটা সোফায় মেয়েটি শকুন্তলা চৌধুরী। এবং আর একটা সোফায় বসেছিলাম পাশাপাশি আমি আর কিরীটী।
একটু আগে শকুন্তলা তার বক্তব্য শেষ করেছে, এবং নিজের কথা বলতে বলতে সে যে যথেষ্ট উত্তেজিত হয়ে উঠেছিল, তার রক্তিম শেষ আভাসটা যেন এখনো তার মুখের উপরে রয়েছে।
ইতিমধ্যে সন্ধ্যার ধূসর আবছায়া চারিদিকে নেমে এসেছিল। এবং বাইরের আলো ঝিমিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে ঘরের মধ্যেও আবছায়া ঘনিয়ে এসেছিল।
আমি সোফা থেকে উঠে গিয়ে সুইচ টিপে ঘরের আলোটা জ্বালিয়ে দিলাম। হঠাৎ ঘরের আলোটা জ্বেলে দেওয়ায় শকুন্তলা যেন একটু নড়েচড়ে বসল।
সামনের ত্রিপয়ের উপরে রক্ষিত টোবাকোর সুদৃশ্য কৌটোটা তুলে নিল কিরীটী এবং হাতের নিভে যাওয়া পাইপটার তামাকের দহ্মাবশেষ সামনে অ্যাসট্রের মধ্যে ফেলে দিয়ে নতুন করে আবার সেটার গহুরে তামাক ভরতে শুরু করল।
আমি কিন্তু শকুন্তলার মুখের দিকেই চেয়েছিলাম।
রোগা ছিপছিপে গড়ন এবং বেশ দীর্ঘাঙ্গী। মুখটা লম্বাটে ধরনের। নাক ও চিবুকের গঠনে একটা যেন দৃঢ়তার ছাপ। দুটি চোখে বুদ্ধির দীপ্তি স্পষ্ট বটে তবে সেই দীপ্তিকে আচ্ছন্ন করে কি যেন আরো কিছু ছিল।
সাধারণ একটি হ্যাঁতের আকাশ-নীল রঙের শাড়ি পরিধানে ও গায়ে একটি চিকনের সাদা ব্লাউজ। দুহাতে একটি করে সরু সোনার রুলি ও বাম হাতের মধ্যমাতে সাদা পোখরাজ ও লাল চুনী পাথর বসানো আংটি ব্যতীত সারা দেহে আভরণের চিহ্নমাত্র নেই। মুখে প্রসাধনের ক্ষীণ প্রলেপ।
কিন্তু ঐ সামান্য বেশেই তরুণীর চেহারার মধ্যে যেন একটি স্নিগ্ধ সুন্দর শ্রী ফুটে উঠেছিল, বিশেষ একটা আভিজাত্য যেন প্রকাশ পাচ্ছিল। তরুণীর বয়স তেইশ-চব্বিশের বেশী হবে বলে মনে হয় না।
পাইপে অগ্নিসংযোগ করে দেশলাইয়ের কাঠির সাহায্যে কাঠিটি অ্যাশট্রের মধ্যে ফেলে দিতে দিতে এতক্ষণ বাদে কিরীটী কথা বলল।
শান্ত মৃদুকণ্ঠে বললে, কিন্তু মিস চৌধুরী, আপনার এই ব্যাপারে আমি কি ভাবে আপনাকে সাহায্য করতে পারি বলুন!
তা আমি জানি না, তবে ঐ লোকটার সঙ্গে সত্যিই যদি আমার বিয়ে হয়, কাকার আদেশ মেনে নিয়ে সত্যিই যদি ওকেই আমায় বিয়ে করতে হয় এবং আপনি যদি এ ব্যাপারে আমাকে
সাহায্য করেন তো আমার সামনে একটি মাত্র পথ খোলা আছে—জানবেন সেটা হচ্ছে সুইসাইড করা।
ছিঃ, সুইসাইড করবেন কেন! বললাম এবারে আমিই।
তাছাড়া আমার অন্য কোন পথই তো নেই সুব্রতবাবু।
বুদ্ধিমতী আপনি, ওভাবে দুর্বলের মত সুইসাইড করতে যাবেন কেন, আপনার কাকাকে আর একবার বুঝিয়ে বলুন না। আমিই আবার বললাম।
কোন ফল হবে না সুব্রতবাবু। বললাম তো আপনাদের, কাকা এ ব্যাপারে অত্যন্ত অ্যাডামেন্ট! তাছাড়া জানি—এবং দেখেছিও তো চিরদিন—ওঁর মতের বিরুদ্ধে কেউ যাবার চেষ্টা করলে তাকে তিনি কিছুতেই ক্ষমা করেন না। তাছাড়া–
কি?
দুষ্মন্ত, সেও কাকার বিরুদ্ধে যেতে রাজী নয়।
দুষ্মন্তবাবু তো আপনারই কাকার ছাত্র, তাই বললেন না? কিরীটী এতক্ষণে আবার কথা বলল।