- বইয়ের নামঃ রক্তলোভী নিশাচর
- লেখকের নামঃ নীহাররঞ্জন গুপ্ত
- বিভাগসমূহঃ গোয়েন্দা কাহিনী
০১. কিছু দিনের ব্যাপার
নিজ হাতে কালকূট নিজের শরীরে সংক্রামিত করে যে কালো ভ্রমর স্বেচ্ছা-মৃত্যুকে বরণ করে নিয়েছিল মিয়াং মিয়াংয়ের মৃত্যুগুহায় ও যার প্রাণহীন (?) দেহ সাশ্রুনেত্রে ইরাবতাঁর জলে ভাসিয়ে দিয়ে কিরীটী ও সুব্রত পরম নিশ্চিন্তে আবার কলকাতায় ফিরে এসেছিল, সেই সমাপ্ত কাহিনীরই যে আবার নতুন করে জের টানতে হবে কে ভেবেছিল! সত্যিই কি বিচিত্র এই মানুষের চরিত্ৰ!
একটা অত্যাশ্চর্য প্রতিভা নিয়েই ডাঃ এস. সান্যাল-কালো ভ্রমর জন্মেছিল, কিন্তু যেন দুর্ভাগ্যের অভিশাপে রাহুগ্ৰস্ত হয়ে নিজের জীবনটাকে তো সে নিজে তছনছ করে দিলই, সেই সঙ্গে অত বড় একটা প্রতিভারও ঘটল অপমৃত্যু।
এবং সেই অপমৃত্যু তিলে তিলে তাকে যেন গ্রাস করছিল অজগর। যেমন তার ধৃত শিকারকে একটু একটু করে গ্রাস করে তেমনি করেই।
দুইটি বৎসরের ব্যবধান।
ইরাবতীকুলের সেই প্রভাতেরই যেন সন্ধ্যা!
সুদূর বর্মা থেকে এবারে কাহিনী শুরু হল কলকাতার পটভূমিকায়।
মৃত্যুগুহা হতে টালিগঞ্জে স্যার দিগেন্দ্রনারায়ণের মাৰ্বল প্যালেসে।
সুব্রতর জবানীতেই এবারের কাহিনী।
শামুক যেমন খোলার মধ্যে আপনাকে মাঝে মাঝে গুটিয়ে নেয়, ঠিক তেমনি কিরীটীকেও মাঝে মাঝে দেখেছি বাইরের জগৎ থেকে যেন আপনাকে গুটিয়ে নিয়ে অদ্ভুত আত্মস্বতন্ত্র এক জগতের মধ্যে যেন সে নিজেকে নির্বাসিত করত।
কয়েক মাস থেকে লক্ষ্য করছিলাম কিরীটীর সেই অবস্থা। বাড়ি থেকে কোথাও বের হয় না। হয় নিজের ল্যাবরেটারী ঘরে, না-হয় বসবার ঘরে সমস্ত দিনটা তো কাটায়ই, এমন কি কোন কোন দিন গভীর রাত পর্যন্তও কাটিয়ে দেয়।
ঐ সময়টা ও বন্ধুবান্ধব কারো সঙ্গেই বড় একটা দেখা করে না। আমিও দুদিন এসে ফিরে গেছি, কিরীটীর সঙ্গে দেখা হয়নি।
দুদিন এসে জেনেছি কিরীটী ল্যাবরেটারী ঘরেই আছে। কিন্তু আমি জানতাম মনের মধ্যে বাইরের জগৎ থেকে সে যখন নিজেকে এভাবে নির্বাসিত করে, তখন কাউকেই সে সহ্য করতে পারে না। সেই কারণেই আমিও তাকে বিরক্ত করিনি।
দিন দশেক বাদে গেলাম।
সেদিনও জানতে পারলাম কিরীটী সকাল থেকে তার ল্যাবরেটারী ঘরের মধ্যেই আছে। জংলীর কাছে সংবাদ নিচ্ছি এমন সময় সহসা ল্যাবরেটারীর দরজা খুলে কিরীটী বের হয়ে এল এবং আমাকে ঘরের মধ্যে দেখতে পেয়ে বলল, এই যে সু, খবর কি? হঠাৎ অনেক দিন এদিকে আসিস না!
আমি মৃদু হেসে বললাম, ঠিক উল্টোটি। আজকে নিয়ে তিনদিন বরং তোরই পাত্তা নেই।
পাত্তা নেই মানে! আমি তো দু মাস ধরে বাড়ি থেকে কোথাও বেরই হই না।
আবার বুঝি কোন জটিল মামলা হাতে নিয়েছিস?
মামলা নয়। মামলা-কাহিনী। বলে জংলীর দিকে তাকিয়ে বললে, এই, চা নিয়ে আয়।
জংলী আদেশ পালনের জন্য ঘর হতে বের হয়ে গেল।
মামলা-কাহিনী মানে? বিস্মিত ভাবে ওর মুখের দিকে তাকালাম।
একটা আত্মচরিত লিখছি।
আত্মচরিত লিখছ?
হ্যাঁ তবে আত্মচরিত সাধারণত যে-রকমটি হয়, এ সে-রকম নয়। আত্মচরিত্যের আত্মটিকে বাদ দিয়ে কেবল জীবনের অভিজ্ঞতাগুলোকে সাজিয়ে যাচ্ছি পর পর।
সত্যি?
হ্যাঁ।
০১.
কিছু দিনের ব্যাপার।
হাতে কোন কাজকর্ম নেই বলে কিরীটী তার বৈচিত্ৰ্যপূর্ণ আত্মজীবনী লিখছিল। রাত্রে সে লিখত এবং যতটুকু লেখা হত। পরদিন প্রত্যুষে সেটা পাঠিয়ে দিত আমাকে পড়তে।
আমি অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গেই সমস্ত দুপুরে পড়ে সেটা আবার সন্ধ্যায় পাঠিয়ে দিতাম।
সত্যিই ডায়েরীটা পড়তে বেশ ভাল লাগছিল।
গতকাল সকালে কী একটা জরুরী কাজে কিরীটী রাণাঘাট গেছে। ডায়েরটা তাই আমার কাছেই রয়ে গেছে।
নতুন করে আর কিছু লেখা হয়নি।
বিকেলের দিকে সে আমাকে রিং করে জানিয়েছে।–রাত্রে আমাদের দুজনের কোথায় নাকি নিমন্ত্রণ আছে; সে এখানেই আসবে, তারপর সন্ধ্যার পর দুজনে একসঙ্গে বেরুবে; আমি যেন প্রস্তুত হয়ে থাকি। ঘড়িতে ঢং ঢেং করে ছটা বেজে গেল।
শীতের রাত্রি, তারপর আবার সন্ধ্যা থেকেই টিপ টিপ করে বৃষ্টি পড়তে শুরু হয়েছে। শীতের হিমেল হাওয়া মাঝে মাঝে উত্তর দিকের জানলার পর্দার ফাঁক দিয়ে ঘরের মধ্যে এসে ঢুকছে বেপরোয়া। ঠাণ্ডা গায়ে যেন ছুচ ফোঁটাচ্ছে।
সোফার ওপরে গা এলিয়ে দিয়ে কিরীটীর আত্মজীবনীটা আবার খুলে বসলাম।
গতকাল ডায়েরীর একটা জায়গা পড়তে পড়তে সত্যিই অদ্ভুত লেগেছিল।
সেই জায়গাটাই আবার পড়া শুরু করলাম।
এ জীবনে অনেক কিছুই বিচিত্র ও অদ্ভুত দেখলাম। কিন্তু নিশাচরদের মত ভয়ঙ্কর বোধ হয়। আর কিছুই নেই। আধুনিক সভ্য সমাজে নিশাচরের অভাব নেই। সাক্ষাৎ শয়তানের যেন প্রতীক এরা, দিনের আলোয় এদের দেখলে চিনতে পারবে না কেউ। অতি শান্ত, শিষ্ট, ভদ্র, বিনয়ী, শিক্ষিত ও মার্জিত রুচিসম্পন্ন, কিন্তু যত রাতের অন্ধকার একটু একটু করে পৃথিবীর বুকে ঘনিয়ে আসে, চারদিক হয়ে আসে নিঝুম, ক্ষুধিত হায়নার মতই ঐ তথাকথিত নিশাচরেরা তখন যেন হয়ে ওঠে রক্তলোলুপ ও হিংস্র ভয়ঙ্কর। তখন এদের দেখলে আঁতকে উঠবে নিশ্চয়ই। তাই বলছিলাম, যদি কোন গভীর রাত্রে, কখনো এই শহরেও ঘরের বদ্ধ দরজায় করাঘাত শোন, দরজা খুলো না। সাবধান, কে বলতে পারে.
এই পর্যন্ত লিখেই হয়তো সে রাতের মত শেষ করেছে। কেননা এর পর আর কিছু লেখা নেই।