- বইয়ের নামঃ রক্তমুখী নীলা
- লেখকের নামঃ নীহাররঞ্জন গুপ্ত
- প্রকাশনাঃ ইলমা পাবলিকেশন্স
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
রক্তমুখী নীলা
১. নিশীথ রাতের আগন্তুক
না—ঘুম আজ আর আসবে না।
হাত বাড়িয়ে বেড-সুইচটা টিপে, শিয়রের কাছে ত্রিপয়ে রক্ষিত টেবিল-ল্যাম্পটা জ্বেলে দিলাম।
মৃদু নীলাভ আলোয় ঘরটা স্বপ্নাতুর হয়ে উঠল মুহূর্তে যেন।
নিস্তব্ধ, নিঃসঙ্গ রাত্রি
কার্তিকের শেষ, কিন্তু ইতিমধ্যেই কলকাতা শহরে বেশ ঠাণ্ডা পড়ে গেছে। পায়ের দিকের খোলা জানালাটা দিয়ে ঝিরঝির করে রাতের হাওয়া এসে ঢুকছে। রাতের অন্ধকারে নিঃশব্দে হিম
ঝরছে, তারই আভাস মধ্যরাতের ঠাণ্ডা হাওয়ায়।
অন্ধকার আকাশের কোলে শূন্যে স্থির হয়ে আছে ইতস্তত কয়েকটি আকাশ-প্রদীপের আলো। দূরে আরও দূরে বিক্ষিপ্ত তারকার দল নৈরাত্রির শিয়রে জাগো
ভিতরে আসতে পারি? হঠাৎ একটা মোটা গলার স্বর শোনা গেল।
চমকে উঠলাম, এত রাত্রে আবার কে ঘরের মধ্যে আসতে চায়? রক্তলোভী কোন নিশাচর নয় তো? রক্তের লোভে এসে হাজির হয়েছে!
বললাম, কে?দরজাটা বন্ধই ছিল, এগিয়ে গেলাম দরজার দিকে একটু।
দরজাটা একটিবার খুলুন না?…
কে?—আবার প্রশ্ন করলাম।
চিনতে পারবেন না আমি আপনার পরিচিত তো নই। দয়া করে একবার দরজাটা যদি খোলেন।
দরজাটা খুলতেই যেন এক ঝলক ঝড়ো হাওয়ার মতই, আমাকে একপ্রকার ধাক্কা দিয়ে। সরিয়ে আগন্তুক আমার শয়নঘরে এসে প্রবেশ করলেন।
চমকে সরে দাঁড়িয়ে আগন্তুকের দিকে দৃষ্টিপাত করলাম। আগন্তুক ততক্ষণে অনাহূতই ঘরের। একটি সোফা অধিকার করে বসে পড়েছেন। তাঁর মাথায় একটা ফেল্টের ক্যাপ, পরিধানে মভ কালারের দামী স্যুটা মুখোনি নিখুঁতভাবে কামানো। চোখে কালো কাঁচের সেলুলয়েডের ফ্রেমে আঁটা চশমা।
কে আপনি?
ভয় পাবেন না—বসুন আমি চোর, ডাকাত বা খুনী নই।
আগন্তুকের সামনে বসে, আমি আর একখানা সোফা অধিকার করে বসলাম। আগন্তুকের দিকে তাকালাম। মুখখানা হাড়-বের-করা, রুক্ষ কঠিন। চোয়ালের দু’পাশের হাড়-দুটো ব’ এর আকারে বিশ্রীভাবে সামনের দিকে উঁচু—সজাগ হয়ে উঠেছে। কপালের দুপাশের শিরাগুলো দড়ির মত জেগে আছে। চোখের দৃষ্টি যেন ধারাল ইস্পাতের ফলার মত ঝকঝক করছে।
বলুন তো কে আপনি? কি চান? আবার প্রশ্ন করি।
আপনিই তো সুব্রত রায়—কিরীটী রায়ের সহকারী ও বন্ধু? হ্যাঁ
। কিন্তু আপনি?
ব্যস্ত হবেন না, বলছি। আমারও পরিচয় একটা আছে বৈকি। …এক গ্লাস ঠাণ্ডা জল খাওয়াতে পারেন? অনেকটা পথ তাড়াতাড়ি এসে বড্ড পিপাসা পেয়েছে।
ভোলা! ভোলা!—চীৎকার করে ভৃত্যকে ডাকলাম।
ভোলা আপনার চাকর বুঝি? বোধহয় সে বাড়িতে নেই। বাড়িতে ঢুকবার সময় দেখলাম সদর দরজাটা শুধু ভেজানো রয়েছে। প্রথমে কড়া নাড়লাম, কিন্তু কোন সাড়া পেলাম না। সাড়াশব্দ না পেয়ে দরজায় ধাক্কা দিতেই দরজাটা খুলে গেল। সামনেই সিঁড়ি দেখে সোজা উপরে উঠে এসেছি। ওদিককার জানালা দিয়ে আলো জ্বলতে দেখে বুঝেছিলাম এ-ঘরে কেউ নিশ্চয়ই আছেন। তবে জেগে আছেন ভাবি নি বড্ড পিপাসা পেয়েছে, যদি আমাকে এক গ্লাস জল…
ভদ্রলোক কথাগুলো একটানা বলতে বলতে থেমে গেলেন।
আমি সোফা হতে উঠে গিয়ে সোরাই থেকে কাঁচের গ্লাসে করে জল এনে ভদ্রলোকের সামনে ধরে বললাম, এই নিন।
জলের গ্লাসটা আমার হাত থেকে নিয়ে এক চুমুকে গ্লাসটা শূন্য করে পাশের ত্রিপয়ের ওপর রাখতে রাখতে আগন্তুক বললেন, ধন্যবাদ।
তারপর একটু থেমে বললেন, এত রাত্রে হঠাৎ এমনি করে বলা নেই, কওয়া নেই আমাকে ঘরে ঢুকতে দেখে খুব আশ্চর্য হয়ে গেছেন নিশ্চয়ই সুব্রতবাবু। অবশ্য তা হবারই কথা বলতে বলতে ভদ্রলোক যেন অত্যন্ত পরিশ্রান্ত হয়ে চোখের পাতাদুটি বোজালেন।
ভদ্রলোকের মুখের দিকে তাকালাম চোখ দুটি তখন আর দেখবার উপায় নেই, কেননা নিমীলিত আঁখিপল্লবের অন্তরালে অদৃশ্য হয়ে গেছে। টেবিল ল্যাম্পের আলোর খানিকটা রশ্মি তির্যক ভঙ্গীতে আগন্তুকের ডানদিকের কপাল ও গালের খানিকটা আলোকিত করে তুলেছে। ভদ্রলোক কিছুক্ষণ চুপচাপ আবার বসে রইলেন, তারপর আবার এক সময় দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রাত্রির স্তব্ধতা ভঙ্গ করে বললেন, সুব্রতবাবু, আপনি হয়ত আমার পরিচয় পাবার জন্য উৎসুক হয়ে উঠেছেনা আমার নাম শৈলেশ্বর সেনা কোন একটা বিশেষ কারণে নিজেকে অত্যন্ত বিপন্ন বোধ করে এত রাত্রে আমাকে আপনার কাছে গোপনে রাতের অন্ধকারে গা-ঢাকা দিয়ে আসতে একপ্রকার বাধ্য হতে হয়েছে। দাঁড়ান এক মিনিট বলতে বলতে শৈলেশ্বরবাবু সোফা থেকে উঠে পড়লেন এবং আমার শয়নঘরের ভেজানো দরজাটা বন্ধ করে এলেনা শৈলেশ্বর বললেন, আসবার সময়ই নিচের সদর দরজাটায় খিল তুলে বন্ধ করে দিয়ে এসেছি। বলতে বলতে ভদ্রলোক আবার চোখ তুলে চশমার কাঁচের ভিতর দিয়েই আমার দিকে যেন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন।
বাড়িতে আর কেউ নেই বুঝি?
সনৎ ও রাজু ওরা দুজনে মাকে নিয়ে কিরীটীর সঙ্গে শিলং গেছে বেড়াতে এখানে আমি একাই। ভোলা চাকর আর রাম ঠাকুর সম্বল দারোয়ানটি পর্যন্ত ভাগলবা…
তা হলে বাড়ি দেখছি খালি! আগন্তুক ভদ্রলোক বললেন।
তা যা বলেন।–হাসতে হাসতে জবাব দিলাম।
শুনুন সুব্রতবাবু, আমি কেন এত রাতে আপনাকে বিরক্ত করতে এসেছি, তাহলে খুলেই বলি। এই যে দেখছেন আমার ডান হাতের অনামিকায় একটি সোনার আংটি—এই বলে ভদ্রলোক ডান হাতখানি আমার সম্মুখে প্রসারিত করে ধরলেন।