- বইয়ের নামঃ যুগলবন্দী
- লেখকের নামঃ নীহাররঞ্জন গুপ্ত
- বিভাগসমূহঃ গোয়েন্দা কাহিনী
০১. ঘরটা অন্ধকার
এখনও রাত্রি—বোধ করি আটটা হবে। দিনের বেলাতেও ডাঃ মনসিজ দাশগুপ্তের এই ঘরে আলো প্রবেশের কোন সম্ভাবনা নেই। সমস্ত জানালা দরজায় ভারী পর্দা ঝোলানো। পর্দার ওপাশে বাইরের কাঁচের শার্সিও বন্ধ। আলো তো নয়ই—শব্দও বড় একটা এ-ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে না। তা ছাড়া ঘরটা দোতলায়—নীচের রাস্তা থেকে অনেকটা উঁচুতে। ঘরের এক কোণে দেওয়ালের গায়ে একটা ছোট্ট লাল ইলেকট্রিক বাল্ব জ্বলছিল—আলোর চারপাশে অন্ধকার দেওয়ালে একটা ঝাপসা লাল আলোর ছায়াপথ যেন সৃষ্টি করেছে।
একটা হাইব্যাক চেয়ারের উপরে সেই অন্ধকার ঘরে বসেছিল গা এলিয়ে অনন্য। বয়স খুব বেশী নয়—চৌত্রিশ কি পঁয়ত্রিশ হবে। মাঝারি সাইজ লম্বায়—বেশ বলিষ্ঠ গঠন, পরনে দামী একটা টেরিটের প্যান্ট ও গায়ে একটা টেরিলিনের হাওয়াই শার্ট। ডাঃ দাশগুপ্তের নির্দেশমতই অনন্য ঐ চেয়ারটার উপর বসে দূরের লাল আলোটার দিকে তাকিয়ে ছিল। লাল আলোটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে অনন্যর দুচোখের পাতা যেন ভারী হয়ে বুজে আসতে চাইছিল। কেমন যেন ঘুম ঘুম পাচ্ছিল। চোখ মেলে থাকতে পারছিল না অনন্য। অল্প দূরে একটা টুলের উপর বসে ডাঃ দাশগুপ্ত। কলকাতা শহরের নামকরা একজন মনোবিজ্ঞানী। নামের শেষে অনেকগুলো বিলাতী ডিগ্রীর লেজুড় আছে। বয়স প্রায় পঞ্চাশের মত, উঁচু লম্বা দেহের গঠন। ব্যক্তিত্বপূর্ণ চেহারা। দৃঢ়বদ্ধ নাসা ও ওষ্ঠ। ধারালো চিবুক, বৃষ-স্কন্ধ। চওড়া বক্ষপট।
ডাঃ দাশগুপ্ত অনন্যকে প্রশ্ন করছিলেন, কেবল একটা কুয়াশা
হ্যাঁ—অনন্য জবাব দেয়, একটা কুয়াশা যেন আমার চারপাশে হঠাৎ এক সময় জমাট বেঁধে উঠতে থাকে—অনন্যর গলার স্বর যেন খুব ক্লান্ত। বলতে বলতে থেমে গেল।
বলুন তারপর—তারপর কি মনে হয় আপনার মিঃ বক্সী?
সেই কুয়াশাটা ক্রমশ জমাট ভারী হতে থাকে যেন সীসের মত। তারপরেই মনে হয় যেন। দমবন্ধ হয়ে আসছে আমার। আর ঠিক সেই মুহূর্তে একটা যেন কণ্ঠস্বর শুনতে পাই–
কণ্ঠস্বর!
হ্যাঁ। সেই কণ্ঠস্বর যেন আমাকে কেবলই বলতে থাকে, যাও যাও—এগিয়ে যাও—কেমন যেন কথাগুলো বলতে বলতে হাঁপাতে থাকে অনন্য—আবার গলার স্বর বুজে আসে তার। ঝিমিয়ে আসে।
বলুন মিঃ বক্সী, থামলেন কেন-বলুন? থামবেন না।
আমি আপ্রাণ চেষ্টা করি, দুকান বন্ধ করে থাকতে চাই—শুনবো না কিছুতেই শুনবো না আমি—কিন্তু পারি না—আমি উঠে পড়ি—সেই কণ্ঠস্বর আমাকে যেন সামনের দিকে ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে যায়—
কোথায়?
উপরে ছাতের সিঁড়ির দিকে—
আপনি সিঁড়িতে ওঠেন?
হ্যাঁ, সেই সিঁড়ি চলে গেছে চারতলার ছাতে সোজা। আমিও সিঁড়ি দিয়ে উঠতে থাকি পা ফেলে ফেলে। আর আমার সামনের সেই জমাট কুয়াশাটাও ঠিক হাত দুই তিন ব্যবধানে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে থাকে আমার আগে আগে একটা কঠিন সংকেতের মত।
তারপর—বলুন–
একসময় চারতলার ছাতে গিয়ে উঠি—সেই কুয়াশা আর সেই কণ্ঠস্বর কখন যে আমাকে ছাতের রেলিংয়ের কাছে নিয়ে যায়—জানতেও পারি না। হঠাৎ একসময় নজরে পড়ে
কি?
কুয়াশাটা যেন পাতলা হয়ে গিয়েছে—আর তার মধ্যে দুলছে আর দুলছে—
কি, কি দুলছে?
একটা পাকানো দড়ির ফাঁস—সেই ফাঁসটা–ফাঁসটা যেন আমার গলায় চেপে বসে আমার শ্বাসরোধ করেনা, না-হঠাৎ চিৎকার করে উঠল যেন অনন্য অন্ধকারের মধ্যেই, না–ঐ—ঐ যে সেই ফাঁসটা—
কোথায় কোথায় ফাঁস? চিৎকার করে ওঠেন ডাঃ দাশগুপ্ত।
ঐ—ঐ যে—দেখতে পাচ্ছেন না!
দপ্ করে ঘরের আলোটা জ্বলে উঠল—লাল আলোটা নিভে গেছে—উজ্জ্বল আলোয় ঘরটা যেন ঝলমল করছে। কিছুই আর অস্পষ্ট নেই। সব স্পষ্ট তীক্ষ্ণ উজ্জ্বল আলোয়।
ডাঃ দাশগুপ্ত দেখলেন অনন্য বক্সীর সারাটা দেহ তখনও কাঁপছে আর তার দুচোখের দৃষ্টিতে একটা আতঙ্ক—সারাটা কপাল জুড়ে ঐ শীতের রাত্রেও বিন্দু বিন্দু ঘাম।
মিঃ বক্সী–বক্সী, শুনছেন?
কে?
আমি ডাঃ দাশগুপ্ত–
অনন্য বক্সীর মুখের চেহারাটা একটু একটু করে স্বাভাবিক হয়ে আসে। সুস্থ স্বাভাবিক দৃষ্টিতে তাকায় অনন্য বক্সী ডাঃ দাশগুপ্তের দিকে।
শুনুন মিঃ বক্সী, সবটাই আপনার মনের একটা ভ্রম। আমি বলছি, হ্যাঁ, ভ্রম—
ভ্রম?
হ্যাঁ—আমরা যাকে বলি হ্যালিউসিনেশন। সবটাই একটা, কল্পনা—বলতে পারেন একটা ড্রিম। ওর মধ্যে কোন সত্য নেই।
কল্পনা! হ্যাঁ কল্পনা। ড্রিম আপনার মনের সবটাই ড্রিম? হ্যাঁ, আপনার অবচেতন মনের একটা দুঃস্বপ্নই আপনার চোখের সামনে ভেসে ওঠে।
তবে সেই কুয়াশা, সেই কণ্ঠস্বর, চলমান কুয়াশা, সিঁড়ি ছাত ছাতের রেলিং—শুধু তাই নয় ডাঃ দাশগুপ্ত, ঐ সময় সেই কণ্ঠস্বর কেবলই যেন আমায় আমায় বলতে থাকে, ঝুলে পড়ো ঝুলে পড়ো-হ্যাঙ দাইসেলফ! হ্যাঙ হ্যাঙ
ওটাও আপনার একটা কল্পনা ছাড়া কিছুই নয়—মনের বিকার। শুনুন, মনকে আপনার শক্ত করতে হবে। কিছু না—সব মিথ্যে। আপনি নিশ্চয়ই মনে মনে গলায় দড়ি দিয়ে ফাঁস লাগাবার কথা ভাবেন—আত্মহত্যা করার কথা ভাবেন!
না, না, তা কেন ভাবব, কেন আমি আত্মহত্যা করব?
হয়ত—
কি?
আপনার মনের মধ্যে একটা দুঃখ আছে–কিছু না পাওয়ার ব্যথা আছে—
না, না—বিশ্বাস করুন ডাঃ দাশগুপ্ত, সেরকম কিছুই নেই–আমার স্ত্রী—সে আমায় ভালবাসে–
ঠিক আছে, একটা ওষুধ দিচ্ছি—রাত্রে শোবার আগে একটা করে ক্যাপসুল খেয়ে শোবেন।