- বইয়ের নামঃ চেকপোস্ট
- লেখকের নামঃ নিমাই ভট্টাচার্য
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
১-২. সত্যি কথা বলতে
০১.
সত্যি কথা বলতে কি এখানে টু পাইস উপরি আয় আছে ঠিকই কিন্তু বড্ড ঝামেলার কাজ। কখন যে কি ঘটে যায় তার কোন ঠিক ঠিকানা নেই। তাই সব সময় টেনশনে থাকতে হয়। কথাগুলো বলে একটু শুকনো হাসি হাসে সামন্ত। আমার দিকে তাকিয়ে হাসে। বোধহয় আমার কাছে সমর্থন বা সমবেদনা চায়।
এত বছর পর ওর সঙ্গে আমার হঠাৎ দেখা। একেবারেই অভাবিত। আমি স্বপ্নেও ভাবিনি হরিদাসপুর চেকপোস্টে ওর সঙ্গে দেখা হবে। কিন্তু সে যাই হোক ও নির্বিবাদে আমার সঙ্গে কথাগুলো বলল। আমি একটু অবাকই হলাম। তবু ভাল লাগল।
ঘরের বাইরে দরজার মাথায় কাঠের ফলকে লেখা আছে এন. সি. সামন্ত অফিসার ইন চার্জ, ইমিগ্রেশন চেকপোস্ট, হরিদাসপুর। এপার ওপারের কাস্টমস ও চেকপোস্টের কর্মী অফিসারদের কাছে ও সামন্ত বলেই পরিচিত। সাধারণ যাত্রীদের কাছে ও ওসি সাহেব, ছোট বড়-মাঝারি দালালরা ওকে বড়বাবু বলে। কেউ কেউ হয়ত ওর একটা নোংরা নামও দিয়েছে এবং তা খুবই স্বাভাবিক। বহু পুলিস অফিসারের অদৃষ্টেই এই বিশেষ নামকরণের সৌভাগ্য জুটে থাকে। শ্রীকৃষ্ণের শত নামের মত পুলিস অফিসারদের খ্যাতি-অখ্যাতি অনুসারে নানা নামকরণ হয়, তা আমি জানি।
দমদম থেকে উড়োজাহাজে উড়ে গেলে ঢাকা মাত্র আধঘণ্টার পথ। প্যান-অ্যাম, ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ, এয়ার ইণ্ডিয়া বা জাপান এয়ার লাইন্সের বিমানে লণ্ডন-নিউইয়র্ক মস্কো-প্যারিস হংকং-টোকিও যাত্রার মত বিমানে ঢাকা যাত্রায় আভিজাত্যও নেই, উত্তেজনাও নেই। শুধু তাই নয়। বিমানবন্দরে আত্মীয় বন্ধুদের উপস্থিতি, পুষ্প স্তবক প্রাপ্তি এবং সর্বোপরি আসন্ন বিদায়-ব্যথায় কাতর হয়ে প্রেয়সীর দুফোঁটা চোখের জলও দেখার সৌভাগ্য হবে না বলেই বিমানে ঢাকা গেলাম না।
আমি একাই যাচ্ছি কিন্তু ঠিক নিঃসঙ্গ নই। বনগাঁ লোক্যালের কামরাতেই কয়েকজনের সঙ্গে আলাপ হয়েছে। শিয়ালদ’ থেকে ট্রেন ছাড়ার সময় এত ভীড় ছিল যে মনে হলো, এবার বোধহয় কুম্ভমেলা বনগাঁতেই হবে। এই ভীড়ের মধ্যে মাত্র বত্রিশ ইঞ্চি বুকের ছাতি সম্বল করে টিকে থাকতে পারব কিনা এই দুশ্চিন্তাতেই বিব্রত ছিলাম। প্রায় অর্ধেক রাস্তা পাড়ি দেবার পর মনে হলো, বোধহয় বৈতরণী পার হতে পারব। একটা সিগারেট ধরিয়ে আশেপাশের যাত্রীদের দেখতেই বুঝলাম, এই কামরাতেই আমারই মত আরো দুচারজন বিদেশযাত্রী বনগাঁ চলেছেন। উপযাচক হয়ে আমার আলাপ করতে হলো না। ব্যাগ থেকে পত্রপত্রিকাগুলো বের করতেই সামনের ভদ্রলোক বললেন, তাড়াহুড়োর মধ্যে শিয়ালদ’তে কাগজ কিনতে পারিনি। আপনার একটা কাগজ দেখতে পারি?
হ্যাঁ, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। কথাগুলো বলতে বলতেই ভদ্রলোকের মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝলাম, ইনি লোক্যাল ট্রেনের নিয়মিত যাত্রী না। অতিরিক্ত লড়াই করার জন্য লোক্যাল ট্রেনের নিত্য যাত্রীদের মুখে যে রুক্ষতা ও ক্লান্তির ছাপ থাকে, তা ওঁর নেই। যাই হোক পত্র পত্রিকাগুলো ওর সামনে এগিয়ে ধরতেই উনি সেদিনের ইকনমিক টাইমস তুলে নিলেন। আমি একটু হেসে বললাম, আপনি নিশ্চয়ই ইকনমিক্সের অধ্যাপক অথবা কোন চেম্বার অব কমার্সের সঙ্গে…
কথাটা শেষ করার আগেই উনি হো-হো করে হেসে উঠে বললেন, আপনি দেখছি কিরীটি রায়।
আমিও হাসি। বলি, আমি একজন তুচ্ছ সাংবাদিক মাত্র।
তাই বলুন। আমি অধ্যাপনা করি।
উনি মাঝারি সাইজের একটা ভি-আই-পি সুটকেস থেকে রিডিং গ্লাস বের করতেই আমি একটু হেসে বললাম, মনে হচ্ছে আপনিও আমারই মত বিদেশযাত্রী।
অধ্যাপক মুখোপাধ্যায় হাসতে হাসতে বললেন, ভিআইপি সুটকেস দেখেই ধরে ফেলেছেন?
আমি শুধু হাসি।
হ্যাঁ, একটা সেমিনারে জয়েন করতে ঢাকা যাচ্ছি। একটু থেমে বললেন, আমার মামারা খুলনায় আছেন। তাই যাতায়াতের পথে খুলনায় কদিন কাটাব বলে এই পথে চলেছি।
-ও!
আমারই বেঞ্চের একটু ওপাশ থেকে হঠাৎ এক নারীকণ্ঠ শুনি, শুধু আপনারা না, আমিও পাসপোর্ট-ভিসা সম্বল করে এই লোক্যালে চড়েছি।
আমি ওর দিকে এক ঝলক তাকিয়েই বলি, তাহলে নারীভূমিকা বর্জিত নাটক নয়।
কথাটা বলেই ভীষণ লজ্জিতবোধ করলাম। ভাবলাম, বোধহয় অন্যায়ও হলো। হাজার হোক উনি যুবতী, এবং সুন্দরী। সুদর্শন যুবকদের চাইতে সুন্দরী যুবতীরা নিজেদের রূপ-সৌন্দর্য সম্পর্কে অনেক সচেতন হন। এবং অহংকারী। ওঁরা মনে মনে আশা করেন, এ বিশ্ব-সংসারের সব পুরুষই ওঁদের রূপ-সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হবেন এবং আরো কত কি! কিন্তু রূপ-সৌন্দর্যের তারিফ করা তো দূরের কথা, কোন পুরুষ কোন কারণে দু একটা কথাবার্তা বললেও সুন্দরী যুবতীরা অসন্তুষ্ট না হলেও অন্তত বিরক্তবোধ করেন। কথাটা নেহাতই মুখ ফসকে বেরিয়ে গেলেও মুহূর্তের জন্য ভয় হলো, হয়ত উনি একটা বিরূপ মন্তব্য করবেন; অথবা আমাকে উপেক্ষা করে অপমানিত করবেন।
তেমন কিছু ঘটল না। জয়ন্তী আমার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বললেন, শুধু নাটকে না, জীবনের কোন ক্ষেত্রেই আমাদের না হলে আপনাদের চলে না।
পাশ থেকে মাসীমা বললেন, ঠিক বলেছ মা।
অধ্যাপক মুখোপাধ্যায় হাসতে হাসতেই বললেন, কোন পুরুষ কী কখনও বলেছে যে তাদের জীবনে মেয়েদের কোন ভূমিকা নেই?