- বইয়ের নামঃ নরেন্দ্রনাথ মিত্রর গল্প
- লেখকের নামঃ নরেন্দ্রনাথ মিত্র
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
মিনি বাস
গুটি চার-পাঁচ মিনি বাস পার্কের কোণে দাঁড়িয়ে আছে। বাস স্ট্যান্ড জায়গা বদলাতে বদলাতে এখন এখানে চলে এসেছে। সীতেশ দু’পা এগিয়ে গিয়ে সামনে যে বাসটা দেখল সেটাতেই উঠতে যাচ্ছিল, বাসের ভিতর থেকে একটি তের-চোদ্দ বছরের ছেলে মুখ বাড়িয়ে বলল, ‘এটা নয় দাদা, এটা নয়। ওই পিছনেরটা যাবে। ছ’শো আট নম্বরে উঠুন।’
হাফ প্যান্ট পরা বাচ্চা ছেলে, মাথায় লম্বা লম্বা চুল। আয়েস করে সিগারেট টানছে ছেলেটা বোধ হয় ক্লিনারের কাজ করে।
একটু এগিয়ে গিয়ে দ্বিতীয় বাসটায় উঠল সীতেশ। কিন্তু এই বাসটিরও ছাড়ার লক্ষণ নেই। ব্যাগ কাঁধে কন্ডাকটার ছেলেটি ড্রাইভারের সীটের বাঁদিকে যে লম্বা বেঞ্চটি আছে তাতে টান হয়ে শুয়ে পড়েছে। একজন প্যাসেঞ্জারকে উঠতে দেখেও সে একই ভাবে পড়ে রইল।
সীতেশ জিজ্ঞাসা করল, ‘এই বাসটা যাবে তো?’
ছেলেটি সংক্ষেপে জবাব দিল, ‘যাবে।’
সীতেশ জিজ্ঞাসা করল, ‘কখন যাবে?’
ছেলেটি বলল, ‘স্টার্টারকে জিজ্ঞেস করুন এইমাত্র একটা বাস ছেড়ে গেল। মিনিট পাঁচ-সাত দেরি হবে।’
একটু দূরে অল্পদিন হল একটা চায়ের দোকান বসেছে। সেখানে কয়েকটি ছেলে জটলা করছে। চা খাচ্ছে। ওই দলে বোধ হয় স্টার্টারও আছে। কিন্তু তাকে ডেকে কিছু জিজ্ঞাসা করবার মত উৎসাহ বোধ করল না সীতেশ।
বেলা একটা। এই সময় সব বাসই একটু দেরিতে দেরিতে ছাড়ো ইচ্ছা করলে সীতেশ এই বাস থেকে নেমে গিয়ে একটা প্রাইভেট বাস ধরতে পারে। আজকাল অনেক রুটের বাসই এই পথ দিয়ে যায় কিন্তু এখন কোন তাড়া নেই। উঠে যখন বসেছে আর নেমে গিয়ে কি হবে। পাঁচ সাত মিনিটের মধ্যে না হোক দশ মিনিটের মধ্যে তো ছাড়বেই।
মিনি বাসে সাধারণত ওঠেন। সীতেশা ভাড়া বড্ড বেশী সাধারণ বাসের চেয়ে চার-পাঁচ গুণ বেশি। যারা গোটা একটা ট্যাক্সিতে যায় কি শেয়ারে যাতায়াত করে তাদের পক্ষে কম। কিন্তু সীতেশের মত সাধারণ বাস-ট্রামের যাত্রীদের পক্ষে এই মিনি বাসে ওঠাও একটা বিলাসিতা তবু মাসের প্রথমে মাইনেটা হাতে পেয়ে একটু বিলাসিতা করতে কারই বা না ইচ্ছা হয়। বাজার খরচটা আপনিই বেড়ে যায় তখন কি আর হিসাব থাকে চতুর্থ সপ্তাহে টানাটানি পড়বে।
একটু হিসাব করে চলতে হয় বইকি সীতেশ গুপ্তকে। সংসারে পুরো মাসের আর্নিং মেম্বার সে একাই। বিধবা মা আছেন। আর আছে দুটি অনূঢ়া বোন। তারা বি.এ. পাস করে বসে আছে। চাকরিও হচ্ছে না। দেখতে সুশ্রী নয় বলে বিয়ের সম্বন্ধও তেমন আসছে না। তবে দাদাকে সাহায্য করার জন্য এদের চেষ্টার অন্ত নেই। ওরা টিউশনি করে, পার্টটাইমের কাজ তা যত কম মাইনেরই হোক, আর কম মেয়াদেরই হোক, পেলেই নিয়ে নেয়। ওদের কোন অভিমান নেই। সংসারে ব্যয় সংকোচের জন্যও যথাসাধ্য চেষ্টা করে চিত্রা আর রমা বোনেদের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ নেই সীতেশের
তবু মাসের শেষে মেজাজ যেন অকারণে কি সামান্য কারণে বিগড়ে যায়। স্বভাব খিটখিটে হয়ে ওঠো নিজের আচরণের কথা ভেবে তখন লজ্জিত হয় সীতেশা মা আর বোনদের সঙ্গে মিষ্টি করে কথা বলো সিনেমার টিকিট কিনে দিতে চায়।
আচার-ব্যবহারের এই বৈষম্য শুধু কি মাসের শেষ কটা দিনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে? তা নয়। সারা মাসের মধ্যেই তা ছড়িয়ে থাকে। রাগটা দপ করে জ্বলে উঠে আবার খপ করে নিভেও যায়। কিন্তু সেই প্রজ্বলনের মুহূর্ত কটি বড় প্রখরা অসহায় তিনটি নারী প্রায় মৌনভাবে শীতের সেই ক্রোধের দীপ্তি সহ্য করে। কিন্তু মনে মনে সব সময়ই যে তারা সীতেশকে ক্ষমা করে তা নয়। তাদের মুখ দেখলেই বোঝা যায় তারা ভিতরে ভিতরে একটা প্রতিবাদ পুষে রেখেছে।
কিন্তু এখন মাসের এই প্রথম সপ্তাহে সীতেশের মন বেশ প্রসন্ন। সরকারী অফিসে আজ সেকেন্ড স্যাটারডের ছুটিা পুরনো বন্ধু রমেন আজ তাকে নিমন্ত্রণ করেছে তার অফিস ছুটি হবে বেলা দেড়টায়। দুজনে মিলে আজ সারাটা দিন একসঙ্গে কাটাবে। রেস্টুরেন্টে খাবে, গল্প করবে, চৌরঙ্গী পাড়ায় সিনেমা দেখবো ম্যাটিনি শো-তে নয়, হয় সন্ধ্যায় না হয় নাইট শো-তো।
মা আর বোনেদের কাছে বলেই এসেছে সীতেশ, ‘ফিরতে যদি রাত হয় চিন্তা কোরো না।’
রমেনও এখন পর্যন্ত বিয়েটিয়ে করেনি। তবে তার ওপর সংসারের এমন দায়দায়িত্ব চেপে নেই। বিয়ে না করাটা ওর খেয়ালখুশির ব্যাপার। ওর কথাবার্তার ধরনে মনে হয় ওর পছন্দমত মেয়ে ঠিক করাই আছে। যে কোন দিন বিয়ে করলেই হল।
মা মাঝে মাঝে সীতেশকে বলেন, ‘চিত্রা রমার কপালে বোধ হয় বিয়ে লেখা নেই। ওদের যা হয় হবে। তুই বিয়েটা করে নো’
সীতেশ মনে মনে হাসে। মা যে মা সেও ভদ্রতা করে ছেলের সঙ্গে নাকি সীতেশের মন পরীক্ষা করে দেখতে চায়?
স্টার্টার বাঁশী বাজিয়েছে। এবার বাসটা ছেড়ে দেবে। হঠাৎ ছুটতে ছুটতে একটি মেয়ে এসে মিনি বাসের ভিতরে ঢুকল। কন্ডাকটার তাকে সাগ্রহে দরজা খুলে দিয়েছে।
দেখেই ওকে চিনতে পারল সীতেশা না চিনবার কোন কারণ নেই। একসঙ্গে দু বছর এম.এ. পড়েছে—ফিলসফি নিয়ে পাস করেছে একই সঙ্গে। কিন্তু সে তো পাঁচ বছর আগেকার কথা।
এই পাঁচ বছরে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। সাধারণ স্বাভাবিক একটি পরিবর্তন রীণার বিয়ে হয়েছে। আগের চেয়ে একটু যেন পুষ্টাঙ্গী, তবু দেখতে খারাপ লাগে না। ওর ফর্সা রং আর লম্বা চেহারার সঙ্গে মানিয়ে যায়। শাঁখাসিঁদুরে ফিকে নীল রঙের শাড়িতে বেশ দেখাচ্ছে রীণাকে।