- বইয়ের নামঃ হিমু এবং একটি রাশিয়ান পরী
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- সিজির বইঃ হিমু সিরিজ
- প্রকাশনাঃ অন্যপ্রকাশ
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস, কল্পকাহিনী
হিমু এবং একটি রাশিয়ান পরী
ভূমিকা
আমাদের কালচারে অনুরোধে টেকি গেলার ব্যাপারটা আছে। লেখালেখি জীবনের শুরুতে প্রচুর টেকি গিলেছি। শেষের দিকে এসে রাইস মিল গেলা শুরু করেছি। “হিমু এবং একটি রাশিয়ান পরী” তার উদাহরণ। বৎসরে আমি একটাই হিমু লিখি। বিশ্বকাপ বাংলাদেশে হচ্ছে বলে দু’জন হিমু। একজন মাঠে বসে খেলা দেখবে অন্যজন পথে পথে হাঁটবে।
হুমায়ূন আহমেদ
নুহাশপল্লী
০১.
মাজেদা খালা গলা নামিয়ে, প্রায় ফিসফিস করে বললেন, পরী দেখবি?
আমি বললাম, কি রকম পরী?
ডানাকাটা পরী।
আমি বললাম, ডানা কাটার ঘা শুকিয়েছে, না-কি ঘা এখনো আছে? শরীরে ঘা নিয়ে ঘুরছে, এমন পরী দেখব না।
মাজেদা খালা বিরক্ত মুখে বললেন, তুই কি সহজভাবে কোনো কথা বলতে পারিস না। ডানাকাটা পরী দেখতে চাস না-কি চাস না? হ্যাঁ কিংবা না বল।
ডানাওয়ালা কিংবা ডানাকাটা কোনো ধরনের পরীই আমার দেখতে ইচ্ছা করছে না। খালাকে খুশি করার জন্যে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লাম।
খালা আমার সামনে 3R সাইজের একটা ছবি রেখে বললেন, এই দেখ ডানাকাটা পরী।
আমি দেখলাম গোঁফওয়ালা এক পরীর ছবি। তার মাথার চুল ব্রাসের মত ছোট করে কাটা। চাইনিজ কাটের হলুদ রঙের একটা সার্ট তার গায়ে। সার্টের নিচে নীল রঙের। হাফ পেন্ট। পরীর হাতে টেনিস র্যাকেট। কপালে ঘাম দেখে মনে হল টেনিস খেলে এসেছে।
খালা বললেন, কেমন দেখলি?
আমি বললাম, ভাল। গোঁফওয়ালা পরীর কথা আগে শুনি নি। ছবি দেখে ভাল লাগল। ফ্রেঞ্চ কাট দাড়ি থাকলে আরো ভাল লাগতো।
খালা গলার স্বর আবারো খাদে নামিয়ে বললেন, ছেলে না, এ মেয়ে। গোঁফ লাগিয়ে ছেলে সেজেছে। তার আসল ছবি দেখলে মাথা ঘুরে সোফায় কাত হয়ে পড়ে যাবি। দশ মিনিট উঠতে পারবি না। বুক ধড়ফড়ানি রোগ হয়ে যাবে। এই দেখ আসল ছবি। এখন বল এই মেয়ে যদি পরী না হয় তাহলে পরী কে?
আমি বললাম, হুঁ।
শুধুই বললি। সুন্দর একটা কথা বল।
আমি বললাম, “কে বলে শারদ শশি এ মুখের তুলা পদনখে পড়ে আছে তার কতগুলো।”
এর মানে কি?
এর মানে হল শরৎ রাতের চাঁদও এই মুখের তুলনা হবে না। শরতের পূর্ণ চন্দ্ৰ পড়ে থাকবে এই তরুণীর পায়ের নখের কাছে।
বাহ। তুই বানিয়েছিস?
কবি ভারতচন্দ্র লিখেছেন। রূপবতী মেয়ে দেখলে উনার মাথা ঠিক থাকত না। নিজে বিয়ে করেছিলেন এক তাড়কা রাক্ষসীকে। ধুমসি আলুর বস্তা। গাত্র বর্ণ পাতিল কালো। দুটা দাঁত খরগোসের মত সব সময় ঠোঁটের বাইরে।
ভারতবাবু এই মেয়েকে বিয়ে করল কেন?
মহিলার উচ্চবংশ বলে বিয়ে করেছিলেন। কবিরা আবার বংশের দিকে দুর্বল।
রাক্ষুসীর কথা বাদ দে। এলিতা মেয়েটাকে বিয়ে করবি? ধান্দাবাজি না, এক কথায় জবাব দে। হ্যাঁ না-কি না?
পরীর নাম এলিতা?
হুঁ। বাবা-মা রাশিয়ান, এলিতা জন্মসূত্রে আমেরিকান। ফটোগ্রাফির উপর কোর্স করেছে। বাংলাদেশে আসছে স্টিল ছবি তুলতে। নাম The Food. ঢাকায়। আসবে ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে। তুই হবি তার গাইড।
আমিতো ইংরেজিই জানি না। গাইড হব কি ভাবে?
খালা বললেন, ঐ মেয়ে টিচার রেখে বাংলা শিখে তারপর আসছে। ওরা যা করে সিরিয়াসলি করে। তোর মত অকারণে রাস্তায় খালি পায়ে হাঁটে না। বাংলাদেশে আসবে তাই বাংলা শিখেছে। তার চায়না যাওয়ার প্রোগ্রাম থাকলে চায়নিজ শিখতো। রাশিয়ান ভাষা সে জানে।
আমি বললাম, ভাষাবিধ পণ্ডিত পরী বিয়ে করা বিপদজনক তারপর তুমি যখন বলছ বিয়ে করব। বিয়ে কি মেয়ে ঢাকায় পৌছার পরপরই হবে? মেয়ে জানে যে আমাকে বিয়ে করছে?
মেয়ে কিছুই জানে না। তুই সারাক্ষণ মেয়ের সঙ্গে থাকবি। তোর উদ্ভট উদ্ভট কথাবার্তা শুনে মেয়ে তোর প্রেমে পড়ে যাবে। প্রেম একটু গাঢ় হলেই আমি কাজি ডেকে বিয়ে দিয়ে দেব। তুই মেয়ের হাত ধরে চলে যাবি আমেরিকা। তোর একটা গতি হয়ে যাবে। এখন বুঝেছিস আমার প্ল্যান।
এই মেয়ের সঙ্গে তুমি জুটলে কি ভাবে?
ইন্টারনেটে। এলিতা আমার ফেসবুক ফ্রেন্ড। তার বয়স একুশ। তার একটাই দুঃখ এখনো না-কি সে কোনো বুদ্ধিমান ছেলে দেখে নি। তার কাছে পুরুষ মানেই গাধা।
ছেলে সেজেছে কেন?
বাংলাদেশে আসবে এই জন্যে ছেলে সেজেছে। ছেলে সেজেই আসবে। যতদিন থাকবে ছেলে সেজে থাকবে। সে এক নিউজে শুনেছে গরিব দেশে শাদা চামড়ার মেয়ের একা যাওয়া মানেই গ্যং রেপিড হওয়া। এলিতা ভেজিটেরিয়ান। সকালে কি নাস্তা খায় জানিস তিনটা কাচা ওকরা।
ওকরা কি জিনিস?
ওকরা হল চ্যাড়স।
দুপুরে কি খায়? অর্ধেকটা কাঁচা লাউ?
হিমু ফাজলামি বন্ধ। আমি এই মেয়েটার বিষয়ে সিরিয়াস। আমি চাই তুইও সিরিয়াস হবি। তোদের দু’জনের বিষয়টা মাথায় কিভাবে এসেছে জানিস?
স্বপ্নে পেয়েছ!
ও আল্লা! সত্যিতো। কিভাবে বললি? আসলেই স্বপ্নে পেয়েছি। এলিতা যখন জানলো সে ঢাকায় আসছে তখনি স্বপ্নটা দেখলাম। দুপুরে খাওয়া দাওয়া করে শুয়েছি। হাতে গল্পের বই। গল্প পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়েছি তখন স্বপ্নটা দেখলাম। একটা ঘোড়ার গাড়িতে করে তোরা দু’জন যাচ্ছিস। পেছনে ব্যান্ডপার্টি। তোর পরনে সুটি টাই। এলিতার পাশে তোকে মোটেই বেমানান লাগছে না?। সুন্দর লাগছে। এলিতা পড়েছে লাল জামদানি। তোর গলার টাইটা লাল।