- বইয়ের নামঃ সে আসে ধীরে
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- সিজির বইঃ হিমু সিরিজ
- প্রকাশনাঃ অন্যপ্রকাশ
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস, কল্পকাহিনী
আক্কেলগুড়ুম – একটি প্রচলিত বাগধারা
[উৎসর্গ
মৃত্যুর কাছাকাছি যাবার মতো ঘটনা আমার জীবনে কয়েকবারই ঘটেছে। একবারের কথা বলি। আমায় হার্ট অ্যাটাক হয়েছে–আমাকে নেয়া হয়েছে হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে। আমি চলে গিয়েছি প্ৰবল ঘোরের মধ্যে, চারপাশের পৃথিবী হয়েছে অস্পষ্ট। এর মধ্যেও মনে হচ্ছে হলুদ পাঞ্জাবি পরা এক যুবক আমার পাশে বসে। কে সে? হিমু না-কি? আমি বললাম, কে? যুবক কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, হুমায়ূন ভাই, আমি স্বাধীন। আপনার শরীর এখন কেমন। শরীর কেমন জবাব দিতে পারলাম না, আবারো অচেতন হয়ে পড়লাম। এক সময় জ্ঞান ফিরল। হলুদ পাঞ্জাবি পর যুবক তখনো পাশে বাসা। আমি বললাম, কে? যুবক কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, আমি স্বাধীন।
হিমুর এই বইটি স্বাধীনের জন্যে। যে মমতা সে আমার জন্যে দেখিয়েছে সেই মমতা তার জীবনে বহুগুণে ফিরে আসুক–তার প্রতি এই আমার শুভকামনা।
হুমায়ূন আহমেদ]
০১.
আক্কেলগুড়ুম নামে বাংলা ভাষায় একটি প্রচলিত বাগধারা আছে। যা দেখে গুড়ুম শব্দে আক্কেল খুবড়ি খেয়ে পড়ে–তাই আক্কেলগুড়ুম। মাজেদা খালাকে দেখে আমার মাথায় নতুন একটা বাগধারা তৈরি হলো।–দৃষ্টিগুড়ুম আক্কেলগুড়ুমে যেমন আক্কেল খুবড়ি খেয়ে পড়ে, দৃষ্টিগুড়ুমে দৃষ্টিরও সেই অবস্থা হয়। আমার দৃষ্টি খুবড়ি খেয়ে মেঝেতে পড়ে গেল। খালা হুলুস্কুল আকার ধারণ করেছেন। ফুলে-ফোঁপে একাকার হয়েছেন। ইচ্ছা করলেই বিশ্বের এক নম্বর মোটা মহিলা হিসেবে তিনি যে-কোনো সার্কাস পার্টিতে জয়েন করতে পারেন। আমি নিজের অজান্তেই বলে ফেললাম—ইয়া হু।
মাজেদা খালা তীক্ষা গলায় বললেন, কী বললি?
আমি বিনীতভাবে বললাম, ইয়া হু বলেছি।
খালা বললেন, ইয়া হু মানে কী?
ইয়া হুর কোনো মানে নেই। আমরা যখন হঠাৎ কোনো আবেগে অভিভূত হই তখন নিজের অজান্তেই ইয়া হু বলে চিৎকার দেই। যারা ইসলামি ভাবধারার মানুষ, তারা বলে ইয়া আলি।
ইয়া হু বলার মতো কী ঘটনা ঘটেছে?
আমি বললাম, ঘটনা তুমি ঘটিয়েছ খালা। তোমার যে অবস্থা তুমি যেকোনো সুমে রেসলারকে প্যারাসিটামল ট্যাবলেটের মতো কুৎ করে গিলে ফেলতে পোর। ব্যাটা বুঝতেও পারবে না।
খালা হতাশ গলায় বললেন, গত বছর শীতের সময় টনশিল অপারেশন করিয়েছি, তারপর থেকে এই অবস্থা। রোজ ওজন বাড়ছে। খাওয়া-দাওয়া এখন প্ৰায় বন্ধ। কোনো লাভ হচ্ছে না। বাতাস খেলেও ওজন বাড়ে। গত পনেরো দিন ভয়ে ওজন করি নি।
ভালো করেছ। ওজন নেয়ার স্টেজ তুমি পার করে ফেলেছ।
আমাকে নিয়ে তোর বক্তৃতা দিতে হবে না। তোকে এ জন্যে ডাকি নি। আরো সিরিয়াস ব্যাপার আছে। তুই চুপ করে বোস। কিছু খাবি?
না।
মাজেদা খালা বিরক্ত হয়ে বললেন, আমার কোনো কথায় না বলবি না। আমি না শুনতে পারি না। গরম গরম পরোটা ভেজে দিচ্ছি, খাসির রেজালা দিয়ে খা। আমার নিজের খাওয়া-দাওয়া সম্পূর্ণ বন্ধ। অন্যদের খাইয়ে কিছুটা সুখ পাই। বাসি পোলাও আছে। পরোটা খাবি না-কি বাসি পোলাও গরম করে দেব?
দুটাই দাও।
মাজেদা খালার বিরক্ত মুখে এইবার হাসি দেখা গেল। তিনি সত্যি সত্যি থপথপ শব্দ করতে করতে রান্নাঘরের দিকে রওনা হলেন। এই মহিলাকে দেড় বছর পর দেখছি। দেড় বছরে শরীরকে হুলুস্কুল পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া বিস্ময়কর ঘটনা। বিস্ময় হজম করতে আমার সময় লাগছে।
তুমি হিমু না?
আমার পিছন দিকের দরজা দিয়ে খালু সাহেব ঢুকেছেন। তিনি এই দেড় বছরে আরো রোগী হয়েছেন। চিমশে মেরে গেছেন। মানুষের চোখে হতাশ ভাব দেখা যায়ইনার শরীরের চামড়ায় হতাশ ভােব চলে এসেছে। তিনি অসীম বিরক্তি নিয়ে আমাকে দেখতে লাগলেন। আমি এই ব্যাপারটা আগেও লক্ষ করেছি— কোনো বাড়িতে যদি কেউ একজন আমাকে খুব পছন্দ করে তাহলে আরেকজন থাকবে যে আমাকে সহাই করতে পারবে না। যতটুকু ভালোবাসা ঠিক ততটুকু ঘৃণায় কাটাকাটি। সাম্যাবস্থা, ন্যাচারাল ইকুইলিব্রিয়াম।
খালু সাহেব বললেন, তুমি এখানে বসে আছ কেন? আমার যতদূর মনে পড়ে তোমাকে আমি বিশেষভাবে বলেছিলাম, ভবিষ্যতে কখনো এ বাড়িতে পা দেবে না। বলেছিলাম না?
জি বলেছিলেন।
তাহলে এসেছি কেন?
খালা খবর পাঠিয়ে এনেছেন। তার কী একটা সমস্যা নাকি হয়েছে।
তুমি সমস্যার সমাধান কীভাবে করবে? আমি আমার জীবনে তোমাকে কোনো সমস্যার সমাধান করতে দেখি নি। তুমি যে-কোনো তুচ্ছ সমস্যাকে ঘোট পাকিয়ে দশটা ভয়াবহ সমস্যায় নিয়ে যাও। সমস্যা তখন মাথায় উঠে জীবন অতিষ্ঠা করে তুলে। তুমি এক্ষুণি বিদেয় হও।
চলে যাব।
অবশ্যই চলে যাবে।
বাসি পোলাও, রেজালা এবং গরম গরম পরোটা ভেজে এনে খালা যখন দেখবেন। আমি নেই, তখন খুব রাগ করবেন।
সেটা আমি দেখব।
খাবারগুলি তখন আপনাকে খেতে হতে পারে।
আমার সঙ্গে রসিকতা করবে না। তোমার সস্তা রসিকতা অন্যদের জন্যে রেখে দাও। গোপাল ভাড় আমার পছন্দের চরিত্র না।
আমি উঠে দাঁড়ালাম। চলে যাবার উদ্দেশ্যে যে উঠে দাঁড়ালাম তা না। যাচ্ছি। যাব। যাচ্ছি। যাব করতে থাকিব, এর মধ্যে খালা এসে পড়বেন। পরিস্থিতি তিনিই সামলাবেন।
খালু সাহেব থমথমে গলায় বললেন, এই যে তুমি যাচ্ছি। আর কখনো এ বাড়িতে পা দেবে না। নেভার এভার। তোমাকে এ বাড়ির সোফায় বসে থাকতে দেখা অনেক পরের ব্যাপার, এ বাড়িতে তোমার নাম উচ্চারিত হোক তাও আমি চাই না। এ বাড়ির জন্যে তুমি নিষিদ্ধ চরিত্র।