- বইয়ের নামঃ পোকা-মাকড়
- লেখকের নামঃ জগদানন্দ রায়
- বিভাগসমূহঃ প্রবন্ধ
০. প্রাণীদের কথা
উৎসর্গ
পরম সাহিত্যানুরাগী
লালগোলাধিপতি
রাজা শ্রীযুক্ত যোগীন্দ্রনারায়ণ
রায় বাহাদুরের
শ্রীকরকমলে
————-
নিবেদন
পুস্তকখানি ছোট ছেলেমেয়েদের জন্য লিখিয়াছি, এজন্য যে-সকল পোকা-মাকড় আমরা সর্ব্বদা দেখিতে পাই তাহাদেরি জীবনবৃত্তান্ত ইহাতে বিশেষভাবে স্থান পাইয়াছে। বৈজ্ঞানিক প্রণালীতে প্রাণীদের শ্রেণী-বিভাগ করিবার চেষ্টা ইহাতে আছে, কিন্তু পাছে বইখানি নীরস হয় এই ভাবিয়া বিশেষ শ্রেণীবিভাগে দৃষ্টি রাখি নাই।
যাহাদের জন্য পুস্তকখানি লিখিয়াছি, তাহারা পুস্তক পাঠে আনন্দ ও শিক্ষা লাভ করিলে ধন্য হইব।
শ্রীজগদানন্দ রায়
ব্রহ্মচর্য্যাশ্রম, শান্তিনিকেতন,
আশ্বিন ১৩২৬।
——-
দ্বিতীয় সংস্করণ
চারি বৎসর পরে “পোকামাকড়ের” দ্বিতীয় সংস্করণের প্রয়োজন হইল। পুস্তকখানি আমাদের বালক-বালিকা ও সাধারণ পাঠকদিগের নিকটে আদর পাইয়াছে দেখিয়া আনন্দ লাভ করিয়াছি।
পুস্তকখানি তাড়াতাড়ি ছাপাইয়া প্রকাশ করিতে প্রথম সংস্করণে যে সকল ক্ষুদ্র ক্রটী ছিল, বর্ত্তমান সংস্করণে তাহা সংশোধন করিয়া দিয়াছি।
শ্রীজগদানন্দ রায়
বিশ্বভারতী
শান্তিনিকেতন,
ফাল্গুন, ১৩৩১
———–
প্রথম কথা
আমরা যে-সকল বস্তু দেখিতে পাই, তাহাদের মধ্যে কতকগুলি জড় এবং বাকি সকলি জীব। জড় ও জীব ছাড়া আর কোনো নূতন জিনিস এই পৃথিবীতে নাই এবং পৃথিবীর বাহিরেও নাই।
বাড়ী-ঘর, পাহাড়-পর্ব্বত, জল-বাতাস এবং মাটি এগুলি জড়। গাছ-পালা, মানুষ-গোরু, পোকা-মাকড় ইহাদের সকলেই জীব।
আমাদের মনে হয়, যাহারা নড়াচড়া করে না, তাহারাই বুঝি জড়; এবং যাহারা চলাফেরা করে, তাহারাই জীব। কিন্তু এই কথাটা ঠিক নয়। যাহারা বাহির হইতে খাদ্য জোগাড় করিয়া নিজেদের দেহ পুষ্ট করে এবং শেষে সন্তান উৎপন্ন করিয়া মরিয়া যায়, এক কথায় বলিতে গেলে তাহারাই জীব। পশু-পক্ষী, গাছ-পালারা দেহের এক-একটা অংশ দিয়া বাহির হইতে খাদ্য সংগ্রহ করে; আর একটা অংশ দিয়া তাহা পরিপাক করিয়া বড় হয়; তার পরে কেহ ফল, কেহ বীজ, কেহ ছোটো ছোটো শাবক উৎপন্ন করিয়া মরিয়া যায়। কাজেই এইগুলিকে জীবের কোঠায় ফেলিতে হয়। মাটি, পাথর, সোনা, রূপা ইত্যাদি আহার করে না, দেহ পুষ্ট করে না, ফল-ফুল বা সন্তান-সন্ততি উৎপন্ন করে না,—কাজেই এইগুলি জীব নয়,—ইহারা জড়।
আমরা এই পুস্তকে জড়ের কথা বলিব না এবং গাছপালা প্রভৃতি যে-সকল জীবকে উদ্ভিদ্ বলা হয়, তাহাদের কথাও আলোচনা করিব না। পোকা-মাকড় ইত্যাদি যে-সকল ছোটো জীবকে আমরা প্রাণী বলি, কেবল তাহাদেরি ক্রমে পরিচয় দিব।
প্রাণীর সংখ্যা
পৃথিবীতে কত রকমের প্রাণী আছে, তোমরা বলিতে পার কি? তুমি হয় ত অনেক ভাবিয়া কুকুর, ঘোড়া, বেজি, কাঠবিড়াল, ব্যাঙ্ প্রভৃতি পঁচিশ-ত্রিশ রকম প্রাণীর নাম করিতে পারিবে। কিন্তু পঁচিশ, পঞ্চাশ বা একশত রকম প্রাণী লইয়া এই পৃথিবী নয়। লোকে যতই খোঁজ করিতেছে, ততই নিত্য নূতন প্রাণীর সন্ধান পাইতেছে। ইংলণ্ড দ্বীপটি কত ছোটো, তাহা তোমরা জান। আমাদের রাজপুতানার চেয়ে ইহা বড় নয়। সেখানে ভয়ানক শীত; আবার শীতকালে বরফ পড়ে। ছোটো প্রাণীরা এই রকম শীতে বাঁচিতে পারে না। কিন্তু তথাপি সেই ছোটো দেশের শীতের মধ্যেও চারিশত বাষট্টি রকমের পাখী দেখা যায়। সমস্ত পৃথিবীতে অন্ততঃ দশ হাজার রকমের পাখী আছে।
মাছ, ব্যাঙ্, সাপ, গোরু, বানর, মানুষ, এই সব প্রাণীর দেহে মেরুদণ্ড অর্থাৎ শির-দাঁড়া আছে। বিছা, কেন্নো, জোঁক, প্রজাপতিদের মেরুদণ্ড নাই। হিসাব করিয়া দেখা গিয়াছে, পৃথিবীতে মেরুদণ্ডযুক্ত প্রাণীই অন্ততঃ পঁচিশ হাজার রকমের আছে।
আমরা হয় ত রুই, কাত্লা, কই, মাগুর প্রভৃতি আট-দশ রকম মাছের কথা জানি, কিন্তু পণ্ডিতেরা দেশ-বিদেশে সন্ধান করিয়া প্রায় আট হাজার রকম মাছের সন্ধান পাইয়াছেন। ইহাদের প্রত্যেকেরই আকার-প্রকার আহার-বিহার স্বতন্ত্র।
গ্রীষ্মকালে রাত্রিতে আলো জ্বালিয়া পড়িতে বসিলে, কত কীট-পতঙ্গ আলোর চারিদিকে ঘুরিয়া বেড়ায়, তাহা তোমরা নিশ্চয়ই দেখিয়াছ। ইহাদের মধ্যে কোনোটা বড়, কোনোটা নিতান্ত ছোটো, কোনোটা কালো, কেনোটা সবুজ, কোনোটা উড়িয়া বেড়ায়, কোনোটা বা লাফাইয়া লাফাইয়া চলে। আমরা হয় ত ইহাদের দুই-একটির নাম জানি। কিন্তু এই হাজার হাজার রকমের পোকা কোথায় থাকে, কি খায়, কি রকমে জীবন কাটায়, পণ্ডিতেরা তাহা অনুসন্ধান করিয়া ঠিক করিয়াছেন। তাঁহারা বলেন, পৃথিবীতে অন্ততঃ চারি লক্ষ রকমের কীট-পতঙ্গ আছে।
আমরা এখানে কেবল কয়েকটিমাত্র প্রাণিজাতির সংখ্যার কথা বলিলাম। প্রত্যেক জাতিতে প্রাণীরা সংখ্যায় কিপ্রকারে বাড়িয়া চলে, তাহার কথা শুনিলে তোমরা আরো অবাক্ হইয়া যাইবে।
মানুষ খুব বুদ্ধিমান প্রাণী; সে বুদ্ধির জোরে অন্য প্রাণীদের উপরে ক্ষমতা দেখায়। কিন্তু তথাপি সাপ, ব্যাঙ্, ফড়িং যেমন এক-একটি বিশেষ জাতীয় প্রাণী, মানুষ তাহার বেশি আর কিছুই নয়। পৃথিবীতে মোট একশত সত্তর কোটি মানুষ আছে। এই কয়েকটি মানুষের মাথা গুঁজিয়া রাখার জন্য পৃথিবীতে অতি অল্প জায়গারই আবশ্যক হয়। তাই সমুদ্রের উপরে, মরুভূমিতে, মেরুদেশের শীতে এবং আফ্রিকা ও আমেরিকার গভীর জঙ্গলে মানুষ ইচ্ছায় বাস করে না। কিন্তু ঐ-সকল জায়গায় অন্য প্রাণীর অভাব নাই। সেখানকার দু’হাত জমিতে হাজার হাজার প্রাণী দেখা যায়। পৃথিবীর জল, স্থল, আকাশ সকলি ছোটো বড় নানা প্রাণীতে পূর্ণ। সমুদ্রের তল এবং পর্ব্বতের গুহা—যেখানে সূর্য্যের আলো কোনো কালে প্রবেশ করিতে পারে না, সেখানেও অসংখ্য প্রাণী বাস করে। আমাদের সমুদ্রগুলির গভীরতা গড়ে প্রায় আড়াই মাইল। তিন মাইল এবং সাড়ে তিন মাইল গভীর জলের তলে যে-সকল অদ্ভুত প্রাণী আছে, তাহার কথা চল্লিশ-পঞ্চাশখানা বড় বড় বইয়ে লেখা হইয়াছে।