- বইয়ের নামঃ ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহল
- লেখকের নামঃ চিত্রা দেব
- প্রকাশনাঃ আনন্দ পাবলিশার্স (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ আত্মজীবনী
০১. ভূমিকা – চিত্রা দেব
ঠাকুরবাড়ির মহিলাদের নিয়ে এখনও অনেক কৌতূহল আমাদের মনে জমে আছে। বাংলার নারীজাগরণের কথা ভালভাবে জানতে গিয়ে দেখলম, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির মহিলারা প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করেছেন। একক বা সম্মিলিত উভয়ভাবেই তাঁরা এসেছেন অন্ধকার ঘরে হঠাৎ প্রদীপ জেলে দেবার মতো। পুরনো কাগজপত্র নেড়েচেড়ে দেখা যাচ্ছে, ঠাকুরবাড়ির মেয়েদের সম্বন্ধে এখনও অনেক কিছুই আমরা জানি না, অথচ ছাড়ানো-ছিটানো হলেও তথ্যের অভাব নেই। তাই এখানে বাংলার সংস্কৃতি জগতে তাদের যথার্থ ভূমিকা, নির্ণয় করার একটা প্রাথমিক চেষ্টা করা হল।
আলোচ্য বিষয়টি গুরুগম্ভীর ও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ হলেও আমরা কিছুটা সরস করে বলার চেষ্টা করেছি, যাতে সব ধরনের পাঠকই তা উপভোগ করতে পারেন। লেখাটি প্রথমে সংক্ষিপ্ত আকারে বার্ষিক সংখ্যা আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। তখন অনেকের আগ্রহ ও অভিনন্দনে উৎসাহিত হয়ে বিষয়টিকে আরো পর্ণাঙ্গ করার ইচ্ছা জাগে। বর্তমান গ্রন্থ তারই ফসল।
এই গ্রন্থ পরিকল্পনার কথা সর্বপ্রথম স্ত্রীরমাপদ চৌধুরীকে জানালে তিনি আমাকে উৎসাহিত করে ব্যাপক অনুসন্ধানের নির্দেশ দান করেন। তাঁর আগ্রহ, সক্রিয় সাহায্য ও প্রয়োজনীয় উপদেশ না পেলে কোনদিনই এ গ্রন্থ লেখা সম্ভব হত না।
কাজে নেমে সবচেয়ে বেশি সাহায্য পেয়েছি, যাঁদের নিয়ে লিখছি তাঁদের এবং তাঁদের আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে। গ্রন্থের শেষে তাঁদের নাম উল্লেখ করেছি বলে এখানে আর পুনরুক্তি করা হল না। তাঁদের কাছে আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। তাঁরা এত অকৃপণভাবে সাহায্য না করলে বাংলার নারীজাগরণের এই ইতিহাস অলিখিত থেকে যেত। বিশ্বভারতীর রবীন্দ্রসদনে অবস্থিত প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ব্যবহার করবার অনুমতি দান করেছেন উপাচার্য সুরজিৎ সিংহ মহাশয়।
গ্রন্থশেষে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির একটি বংশলতিকা দেওয়া হয়েছে। এই দীর্ঘ ও বিস্তৃত বংশলতিকা নির্মাণে সক্রিয় সাহায্য করেছেন ঠাকুরবাড়ির সকলেই। বিশেষভাবে সাহায্য পেয়েছি শ্রীকল্যাণি বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছ থেকে। বংশলতিক বিন্যাসে ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছেন শ্রীসঞ্জয় দে, এদের সকলকে ধন্যবাদ জানাই। যথাসম্ভব চেষ্টা সত্ত্বেও সমস্ত নাম সংগ্রহ করতে না পারায় বর্তমান সংস্করণে কিছু কিছু, অসম্পূর্ণতা রয়ে গেল। আশা রাখি, পরবর্তীকালে সেই এটি সংশোধন করে নেওয়া সম্ভব হবে।
০১. ভোরের আলো
ভোরের আলো আকাশের সীমা ছাড়িয়ে সবে নেমে এসে পড়েছে বাড়ির ছাদে, অন্ধকারের আবছা ওড়নাটা তখনও একেবারে সরে যায়নি, এমন সময় শিশিরভেজা ঘাস মাড়িয়ে রুক্ষ পথের বুকে এসে নামে দুটো আরবী ঘোড়া। সদর। ছাড়িয়ে জোর কদমে এগিয়ে চলে গড়ের মাঠের দিকে। দারোয়ান কাজ ভুলে যায়। প্রতিবেশীরা হতভম্ব। রাজপথের লোকেরা অবাক। এ কী কাণ্ড? বিস্ময়ে গালে হাত দিয়ে তাকালে একে অপরের দিকে। সবাই চেয়ে আছে। কিন্তু সেদিকে তাকাবার সময় কই আরোহীদের। না, ভুল বলা হল বুঝি। দুজন আরোহী কোথায়? একজন যে অরোহিণী! আরোহিণী? চোখের ভুল নয়ত? কলকাতার রাস্তায় ঘোড়ায় চড়া মেয়ে? তাও মেমসাহেব নয়, বাঙালী। পথিকরা থমকে দাঁড়ায়। চোখ কপালে ওঠে পড়শিনীর। না, আর কোন ভুল নেই। ঐ তো আঁটসাঁট পোশাকে দৃপ্ত ভঙ্গিতে ঘোড়ার পিঠে বসে আছেন কাদম্বরী, ঠাকুরবাড়ির জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী। ঘোড়ায় চড়ে বেড়াতে চলেছেন স্বামীর সঙ্গে, ময়দানের দিকে।
আজও মনে হয়, যেন গল্প শুনছি। তবু গল্প নয়, একেবারে সত্যি ঘটনা। চার দেওয়ালের গণ্ডি ছাড়িয়ে সব কিছুতে বড়-হয়ে-ওঠা এক আশ্চর্য মায়াপুরীর কথা। জোড়াসাঁকোর কর্কশ হৈ-হট্টগোলের মাঝখানে প্রায় হারিয়ে যাওয়া ছোট্ট একটা গলির শেষে যে সেকেলে মস্ত বাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে, বাইরে থেকে তাকে বিশেষত্বহীন মনে হলেও বাংলার নবযুগের বিকাশ হয়েছিল এই ঠাকুরবাড়িতেই। ঝিমিয়ে-পড়া সমাজের বুকে একটার পর একটা আঘাত হেনে যারা তার জড়তা ঘোচাতে চেষ্টা করেছিলেন, তাদের অনেকেরই স্থায়ী ঠিকানা ছিল সেদিনকার জোড়াসাঁকো-ঠাকুরবাড়ি। পুরনো দিনের দু-চারটে পুথি-পত্র, পাঁচালী-কবিগান আর বিকৃত বাবু-কালচারের সংকীর্ণ খাতে দেশের শিল্প-সাহিত্য যখন কোনরকমে নিজেদের টিকিয়ে রেখে চলছে সেই সময়কার কথা। পশ্চিম দিগন্তের একটুখানি আলো এসে পড়ল পুবের আকাশে। সেই নবজাগরণ। লজ্জার মতো গোলাপী আভাটাই শেষে আগুন হয়ে উঠল একদিন। তার আকস্মিক উত্তেজনায় যখন অনেকে দিগভ্রান্ত, কেউ বা পথচ্যুত কিংবা বিদ্রোহী, তখন প্রথম ঊষার সবটুকু লালিমা নিজের গায়ে মেখে এই ঠাকুরবাড়িই সারা দেশের ঘুম ভাঙাবার ভার নিয়েছিল। তারই সামান্যতম নজির ওপরের ঐ গল্পের মতো ঘটনাটা।
কাগজপত্রের খুঁটিনাটি বিবরণের মধ্যে না গিয়ে রেনেসাঁসের সমসাময়িক ঘটনাগুলোর ওপর হালকা নজর বুলিয়ে নিলে দেখা যাবে তখনও তেমন কোন সমবেত চেষ্টা শুরু হয়নি। সর্বত্র শুধু তামসী রাতের গাঢ় ছায়া। তারই মধ্যে এখানে সেখানে দু-একটি প্রদীপ সবে জ্বলেছে, কোথাও বা সলতে পাকাবার আয়োজন চলছে। কিন্তু একটার সঙ্গে আরেকটার কোন যোগ নেই। নবজাগরণের পটভূমি থেকে ঠাকুরবাড়িকে সরিয়ে নিলে এই হবে সেকালের বাংলাদেশের খাটি ছবি। এইরকম দু-একটা প্রদীপের আলো সম্বল করে আমাদের জীবনে নব্য রেনেস কি আজকের রূপ নিয়ে আসত, না ষোড়শ শতকের চৈতন্য রেনেসাঁসের মতো স্মৃতি হয়ে থাকত কে জানে? সেইসব দুর্ভাগ্যের কথা ভেবে মাথাব্যথা করে লাভ নেই। আমরা শুধু বলতে চাই যে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্ত্য ভাবসংঘাতের যুগে ঠাকুরবাড়িতেই প্রথম একটা সহিষ্ণু সমবায়িতার ক্ষেত্র গড়ে ওঠে। তাই সহজেই এ বাড়ির প্রতিটি মানুষের কল্পনায় ঢেউ তুলেছে পশ্চিমের সমুদ্র, ভাবনা ছুয়েছে হিমালয়ের শিখর। আধুনিক বাংলার সুরুচি ও সৌন্দর্যবোধের প্রায় সবটাই তো ঠাকুরবাড়ির দান। ছোট্ট একটা প্রশ্ন এসে পড়েই—ঠাকুরবাড়ির এই স্পর্শমণিটি কি রবীন্দ্রনাথ? স্বাভাবিকভাবেই মনে হবে তার কথা। শুধু ঠাকুরবাড়িকে কেন, সারা বাংলাদেশকে স্মরণীয় করে রাখার জন্যে যিনি একাই যথেষ্ট। তবু একথাও তো সত্যি, ঠাকুরবাড়ি কোনদিনই আর পাঁচটা সাধারণ বাড়ির মধ্যে আটপৌরে ধরনের ছিল না। অনেকদিন, সম্ভবতঃ দ্বারকানাথের আমল থেকেই এ বাড়িতে জীবনযাত্রার নিজস্ব একটা সংস্কার গড়ে উঠেছিল। প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের কোন অনুভূতি, কোন চিন্তাই সেখানে বাধা পায়নি। তাই একই পরিবারে ব্রহ্মবিদ মর্যর সঙ্গে সিভিলিয়ান অফিসারের সহাবস্থান যেমন বেমানান হয়নি তেমনি কবি-সঙ্গীতজ্ঞ-নাট্যকার-শিল্পরসিক-দার্শনিক-চিন্তাবিদের একত্র সমাবেশও সম্ভব হয়েছিল।