- বইয়ের নামঃ লালমৃত্যুর মুখোশ – এডগার অ্যালান পো
- লেখকের নামঃ চিত্তরঞ্জন মাইতি
- বিভাগসমূহঃ অনুবাদ বই
অকাল সৎকার
জীবিত অবস্থায় কবরস্থ হওয়ার প্রশ্ন নিতান্তই অবান্তর। আর যদি এ ধরণের দুর্ভাগ্য কারও জীবনে ঘটে, বলতেই হবে সেটি তার চরম দুর্ভাগ্য। অবশ্য জীবন-মৃত্যুর মধ্যে সীমারেখাঁটি অত্যন্ত অস্পষ্ট আর অনির্দিষ্ট। কে বলবে ঠিক কোন বিন্দুতে একটির সমাপ্তি, অন্যটির সূত্রপাত? কোন কোন রোগের কথা আমরা জানি যে সব ক্ষেত্রে মানুষের সাধারণ জীবনলক্ষণ সাময়িকভাবে অনুভবই করা যায় না। এগুলিকে বোধহয় ক্ষণিক বিরতি বলাই সঙ্গত। মানবদেহের মধ্যে যে বিচিত্র যান্ত্রিকক্রিয়া চলেছে এইসব ক্ষেত্রে অত্যন্ত সাময়িকভাবে সেগুলি স্তব্ধ হয়ে যায়। একটা নির্দিষ্ট সময় ফুরোলেই কোন অদৃশ্য হাতের ইঙ্গিতে কলকজাগুলো আবার সচল হয়ে ওঠে। এ যে কী ভাবে ঘটে যায় তার কারণ আজও রহস্যাবৃত। জীবনের রজতসূত্রটি চিরদিনের জন্য ছিন্ন হয়ে যায়না বা এই সব ঘটনার মুহূর্তে মানবজীবনের স্বর্ণাধারটিও চিরকালের মত চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায় না। শুধু একটি প্রশ্নই জেগে থাকে,– দেহযন্ত্রের এই সাময়িক বিরতির সময় আত্মার কী অবস্থা হয়?
যে সিদ্ধান্তেই আমরা উপনীত হইনা কেন বা কাজের প্রকৃতি যে ধরণের ফল উৎপাদন করুক না কেন, আমাদের হাতে এমন সাক্ষ্য প্রমাণ আছে যা দিয়ে প্রমাণ করা যায় যে প্রকৃত মৃত্যুর পুর্বে বহুক্ষেত্রেই মানুষকে কবর দেওয়া হয়েছে। আমাদের এবং চিকিৎসকদের সম্মিলিত অভিজ্ঞতা থেকে এ ধরণের অজস্র প্রমাণ উপস্থিত করা যায়। সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে এমন শতাধিক কাহিনী তত আমারই জানা আছে। এগুলির মধ্যে বাপ্টিমোর শহরের সাম্প্রতিক ঘটনাটি তার আপন বৈশিষ্ট্যে আমাদের স্মৃতির মধ্যে উজ্জ্বল হয়ে আছে। ঐ ঘটনা অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই ব্যাপক বেদনাজনক উত্তেজনা সৃষ্টি করেছিল। কংগ্রেসের একজন সদস্য হঠাৎ ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েন আর চিকিৎসকেরা তাকে সুস্থ করে তুলতে সম্পূর্ণরূপেই ব্যর্থ হন। দীর্ঘদিন রোগ ভোগের পর তার মৃত্যু ঘটে–অন্তত মৃত্যু হয়েছে বলে ধরে নেওয়া হয়। তাঁর মৃত্যু হয়নি এরকম সন্দেহ পোষণ করার কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ ছিল না। নাড়ির গতি স্তব্ধ হয়ে শরীরের উত্তাপ পুরো পুরি চলে গিয়েছিল, তাছাড়া জ্যোতিহীন চোখ, বিবর্ণ অধরোষ্ঠ আর মুখের আকৃতিগত পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে মৃত্যুর সমস্ত প্রমাণ স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। কবরে নামিয়ে দেওয়ার আগে তিনদিন দেহটিকে ঘরে শুইয়ে রাখা হয়েছিল আর এর মধ্যেই ওটা পাথরের মত শক্ত হয়ে গিয়েছিল। দেহটিতে পচনক্রিয়া শুরু হয়েছে বলে যে মুহূর্তে সবাই সন্দেহ করেছেন, সেই মুহূর্তেই দেহটিকে কফিনে পোরার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
কফিনটিকে এরপর পারিবারিক ভল্টের মধ্যে তুলে রাখা হয়। তিন বছর পর কফিনটি বার করে নেবার জন্যে দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে মৃত মহিলার স্বামী বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যান। ভল্টের দরজা খোলার মুহূর্তেই সাদা পাথরের টুকরোর মত কিছু জিনিস তার হাতের ওপর এসে পড়ে। তার মৃত পত্নীর কঙ্কাল ছিল সেগুলো। শবাচ্ছাদনের বস্ত্রটিও ছিল অবিকৃত।
খুব সতর্কতার সঙ্গে অনুসন্ধান চালিয়ে বোঝা যায় যে তাকে কফিনে পুরে দেবার দিন দুয়েকের মধ্যেই তিনি বেঁচে ওঠেন। বেঁচে ওঠার পর কফিনের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসার যে প্রাণান্তকর চেষ্টা তিনি করেন তারই ফলে ওটা উঁচু তাক থেকে মেঝেতে পড়ে যায়। এর ফলে কফিনটা ভেঙে যায় আর মহিলাটি তা থেকে সহজেই বেরিয়ে পড়েন। ভল্টের মধ্যে তেলভর্তি একটা লণ্ঠন ভ্রমক্রমে থেকে গিয়েছিল। এখন কিন্তু ওর মধ্যে একবিন্দু তেলও ছিল না। হতে পারে যে পুরো তেলটুকু শুকিয়ে গেছে। ভন্টের মধ্যে নেবে যাবার যে ধাপগুলো তারই ওপরটিতে কফিনের একটা বড় কাঠের টুকরো পড়ে ছিল। বোঝা গেল ওইটে দিয়ে ভল্টের লোহার দরজায় আঘাত করে মহিলাটি বাইরের লোকের দৃষ্টি আকর্ষণ করার ব্যর্থ চেষ্টা করেছিলেন। এরপর হয় ভয়েই নয়ত দীর্ঘকাল মূৰ্ছা যাবার ফলে তার মৃত্যু হয়েছে। মেঝেতে পড়ে যাবার সময় ওঁর কাপড় একটা লোহার পেরেকে বেধে যায়, তাই সোজা দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় দেহটা পচে নষ্ট হয়ে যায়।
১৮১০ খ্রীষ্টাব্দে ফ্রান্সে এই ধরণেরই এমন একটা ঘটনা ঘটেছিল যাতে আমরা প্রমাণ পেয়েছিলাম যে সত্য ঘটনা গল্প উপন্যাসের চাইতেও কখনো কখনো অবিশ্বাস্য মনে হয়। এ গল্পের নায়িকা কুমারী ভিক্টোরাইন লাফোর্কেড এক বিখ্যাত বিরাট ধনী পরিবারের সুন্দরী কন্যা। প্যারিসের এক দরিদ্র সাংবাদিক ও সাহিত্যিক জুলিয়েন বোসেট ছিলেন ঐ লাফোর্কেডের অন্যতম পাণিপ্রার্থী। বোসেটের প্রতিভা আর অমায়িক ব্যবহারের দরুন মেয়েটি ওঁর প্রতি আকৃষ্ট হয় আর তাকে ভালবাসতে শুরু করে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওর নজর পড়ে ধনী আর রাজনীতিবিদ মঁসিয়ে রেনেলের ওপর। বিরাট ধনসম্পত্তির উত্তরাধিকারিণী লাফোর্কেড প্রতিপত্তিশালী রেনেলকেই বিয়ে করেন। বিয়ের পর কিন্তু এই ভদ্রলোক মেয়েটিকে যে শুধু অবহেলা করতে থাকেন তাই নয়, যথেষ্ট পরিমাণে দুর্ব্যবহারও আরম্ভ করেন। কয়েকটা বছর শোচনীয় জীবন কাটাবার পর লাফোর্কেডের মৃত্যু হয়। বলা উচিত যে যারা সে সময় তাকে দেখেছিল তারা মেয়েটির শরীরে মৃত্যুর লক্ষণই দেখেছিল। ওর কফিন কিন্তু ভল্টে রাখা হয়নি, গ্রাম্য কবরখানায় সেটি সমাহিত হয়। যদিও হতাশায় পুরো ভেঙে পড়েছিলেন তবু বোসেটের জীবনে কুমারী লাফোর্কেডের প্রেম এমন প্রভাব বিস্তার করেছিল যে দূর গ্রামে গিয়ে কবর থেকে মেয়েটির অদ্ভুত সুন্দর চুলের একটি গুচ্ছ সংগ্রহ করার সঙ্কল্প করেন। গাঁয়ে পৌঁছে দুপুর রাতে কবর খুলে বোসেট চুলের গুচ্ছ নিতে গিয়ে মেয়েটির চোখের দিকে তাকিয়ে চমকে ওঠেন। আসলে মেয়েটির তখনো মৃত্যু হয়নি। শরীর থেকে প্রাণসত্তা পুরোপুরি চলে যায়নি বলেই প্রেমিকের স্পর্শে সে যেন ঘুমের থেকে জেগে উঠেছিল। বোসেটতাড়াতাড়ি মেয়েটিকে পাশের একটা বাড়ীতে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করিয়ে সুস্থ করে তোলেন। লাফোর্কেড বোসেটকে চিনতে পারে আর যতদিন না তার শরীর পুরো সেরে ওঠে ততদিন তারই কাছে থাকে। লাফোর্কেডের নারীহৃদয় অকৃতজ্ঞ ছিল না তাই নবলব্ধ জীবনের সমস্তটুকু প্রেম সে বোসেটকেই অর্পণ করেছিল। সে যে জীবন ফিরে পেয়েছে এ খবর প্রচার না করে বা স্বামীর কাছে ফিরে না গিয়ে সে বোসেটের সঙ্গে আমেরিকা চলে যায়। বিশ বছর পরে ওরা যখন প্যারিসে ফিরে আসে তখন মেয়েটির অনেক পরিবর্তন হয়েছে। ওদের ধারণা ছিল কেউ লাফোর্কেডকে চিনতে পারবেনা, কিন্তু আশ্চর্য! প্রথম দর্শনেই মঁসিয়ে রেনেল ওকে চিনতে পারলেন আর স্ত্রী হিসেবে দাবী করে বসলেন। শেষ পর্যন্ত আদালতের রায় গেল লাফোর্কেডের পক্ষে। বিচারক ঘোষণা করলেন, ঘটনার বৈশিষ্ট্য এবং সুদীর্ঘকাল স্বামীর কাছ থেকে দূরে থাকার ফলে আইনত মেয়েটির ওপর রেনেলের অধিকার নষ্ট হয়ে গেছে।