- বইয়ের নামঃ ইতিহাসের মুক্তি
- লেখকের নামঃ অতুলচন্দ্র গুপ্ত
- বিভাগসমূহঃ ইতিহাস
ইতিহাস
প্ৰাচীন ভারতবর্ষের যে ইতিহাস নেই এই ঘটনায় আমরা কখনও লজ্জা পাই, কখনও গর্ব করি। আর সব সভ্যজাতির লোকেরা তাদের জয়-পরাজয় কাজ-আকাজের নানা কাহিনি লিখে গেছে, প্রাচীন হিন্দু তা করেনি। এই স্বাতন্ত্র্যকে, মনের অবস্থা—মতো, আধ্যাত্মিকতার প্রমাণও বলা চলে, আবার ঐতিহাসিক বোধের অভাবও বলা যায়। কিন্তু প্ৰাচীন ভারতবাসীর কথা যাই হোক, নবীন ভারতবাসীর ইতিহাসকে উপেক্ষা করার জো নেই। আধ্যাত্মিকতার দাবি তাদের পূর্বপুরুষদের ছেড়ে দিতে হয়েছে, সুতরাং আধুনিকতার দাবি আর ছাড়া চলে না, এবং ঐতিহাসিক বোধ হচ্ছে আধুনিকতার একটা প্রধান লক্ষণ। নবীন ভারতবাসীর প্রাচীন ভারতবর্ষের ইতিহাস অনুসন্ধানের চেষ্টার মধ্যে প্রাচীনের উপর ঔৎসুক্য যতটা আছে, আধুনিকতার দৌড়ে পিছিয়ে পড়ার লজ্জা তার চেয়ে কম নেই।
মতোই একটা অদ্ভুত ফল। প্রাচীন যুগের কথা শোনার মানুষের যে স্বাভাবিক আগ্রহ, আর ভবিষ্যৎ-মানুষকে নিজের কথা শোনাবার যে প্রবল আকাঙ্ক্ষা, এই দুয়ে মিলে প্রকৃত ইতিহাসের সৃষ্টি। আজকের দিনের যেসব ছোটখাটো তুচ্ছ ঘটনা, অখ্যাত মানুষের অকিঞ্চিৎকর কাহিনি, মানুষের চোখ ও মন স্বভাবতই এড়িয়ে যায়, হাজার বছর আগেকার ঠিক এমনি সব ব্যাপারের কথা শুনতে মানুষের কৌতুহলের সীমা নেই। আবার হাজার বছর পরের মানুষের কাছে এইসব তুচ্ছ ঘটনা ও নগণ্য কাহিনিই কবির কথায়–’সেদিন শুনাবে তাহা কবিত্বের সম।।’
অতীতের আলো-ছায়ার খেলায় মানুষের মনে যে বিস্ময়রসের সৃষ্টি করে ইতিহাসের তাই প্রধান আকর্ষণ। আর ছবি এঁকে, মুর্তি গড়ে, অক্ষরে লিখে অনাগত কালকে নিজের কথা জানাবার মানুষের যেসব উপায়, তারাই ইতিহাসের প্রধান উপকরণ। ভবিষ্যৎকে লক্ষ্য না করে শুধু বর্তমানে আবদ্ধ মানুষের যে ক্রিয়াকলাপ ও জীবনখাতা, তার প্রত্নখণ্ড দিয়ে ইতিহাসকে পরীক্ষা করা চলে, সৃষ্টি করা চলে না। মানুষ প্রাচীন ইতিহাস জানতে পারে, প্রাচীন কালের লোকেরা কোনও-না-কোনও উপায়ে সে ইতিহাস জানিয়ে গেছে বলে।
মানুষ অতীতের মধ্যে নিজেকে দেখতে চায়, ভবিষ্যৎকে নিজের স্পর্শ দিতে চায়। ইতিহাস এই আকাঙ্ক্ষা-নিবৃত্তির উপায়। কিন্তু যাঁরা ইতিহাস লেখে ও যাঁরা ইতিহাস পড়ে তারা এ কথা মানতে রাজি নয় যে, ইতিহাসের কাজ মানুষ সম্বন্ধে মানুষের কৌতুহল মেটানো। তাদের মতে এতে ইতিহাসকে অতি খাটো ও খেলো করা হয়। যে জিনিস মানুষের হাতে, হাতিয়ারের যে কাজ তার সাহায্য না করে, তার আবার মূল্য কী? সুতরাং তাঁরা প্ৰমাণ করে যে ইতিহাস মানুষের মহা উপদেষ্টা। অতীতের আলো দিয়ে ইতিহাস বর্তমানের পথ দেখায়। বর্তমানের ঘটনা বা উদ্যোগ-অনুষ্ঠান অতীতের ঘটনা-প্রবাহের সহিত কাৰ্য-কারণ সম্বন্ধে অচ্ছেদ্যরূপে বদ্ধ, মানবের সমাজগত জীবনের অখণ্ড ঘটনা-প্রবাহের প্রত্যক্ষ অংশ; সুতরাং বর্তমানের উদ্যোগ-অনুষ্ঠান সুচারুরূপে পরিচালিত করিতে হইলে অতীতের ইতিহাসের ধারা দেখিয়া শুনিয়া লওয়া, অর্থাৎ প্রচলিত কথায় যাহাকে বলে দেশ কাল পাত্র তাহা সাবধানে হিসাব করিয়া কাৰ্যক্ষেত্রে অগ্রসর হওয়া কমী মাত্রেরই কর্তব্য, নতুবা অনেক ভ্ৰম-প্ৰমাদ ঘটিতে পারে।’
বর্তমান যদি ‘অতীত’ কারণের কার্য হয়, অখণ্ড ঘটনা-প্রবাহের একটা অংশ মাত্র হয়, তবে ওই প্রবাহের বেগে তা নির্দিষ্ট ভবিষ্যতের দিকে ভেসে যাবেই। ইতিহাস সে দিকটা পূর্ব থেকে বলে দিতে পারে এ যদি সত্যও হয়, তবুও সে জ্ঞানের ফলে দিকের কোনও পরিবর্তন ঘটার কথা নয়। স্রোতের টানে কোথায় যাচ্ছি তা জানা থাকলেই সে গতিকে কিছু নিয়ন্ত্রিত করা যায় না। আর কমীরা যে দেশ-কাল-পাত্রের হিসাব করে কর্মে সফলতা লাভ করে তা বর্তমান দেশ, বর্তমান কাল ও বর্তমান পাত্র। সে বর্তমানের অতীত ইতিহাস অবশ্য আছে, কিন্তু কমীর যা সাবধানে হিসাব করতে হয় তা ওই ইতিহাস নয়, ইতিহাসের ফলে যে বর্তমান গড়ে উঠেছে সেই বর্তমান। যাকে পাথর কাটতে হয়, পাথরের গড়ন জানা তার দরকার। কিন্তু সে গড়নের যে ইতিহাস ভূতত্ত্ব থেকে জানা যায় তাতে তার প্রয়োজন হয় না। আর ভূতত্ত্বের পণ্ডিত যে পাথর কাটার কাজে অন্যের চেয়ে সহজে ওস্তাদি লাভ করতে পারে এ কথা অবশ্য কেউ বিশ্বাস করে না। পৃথিবীর বড় কর্মীরা সকলেই নিজের প্রতিভার আলোতে বর্তমানকে চিনে নিয়েছে, ইতিহাসের আলোতে নয়।
প্ৰাচীন ইতিহাসের যে বর্তমানকে চেনাবার শক্তি কত কম ঐতিহাসিক গিবন তার একটা ‘ক্লাসিক’ উদাহরণ রেখে গেছেন।
এডোয়ার্ড গিবনের তুলি রোম-সাম্রাজ্য-ধ্বংসের বারোশো বছরের যে ইতিহাস ঐকেছে, তার মতো প্ৰকাণ্ড ও জটিল ঐতিহাসিক চিত্র আর কোনও ঐতিহাসিক কখনও আঁকেনি। এই বহু জন, বহু জাতি ও বহু ঘটনা-সংঘাতের বিচিত্ৰ কাহিনির বর্ণনায় গিবন মানব-সমাজের স্থিতি গতি ও ধ্বংসের যে উদার গভীর ও সূক্ষ্ম জ্ঞানের পরিচয় দিয়েছেন সকল ঐতিহাসিকের তা চিরদিন বিস্ময় জাগাবে। গিবন রোমান সাম্রাজ্য থেকে মাঝে মাঝে চোখ তুলে তাঁর সমসাময়িক ইউরোপীয় রাজ্যগুলির দিকে তাকিয়েছেন। পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্য ধ্বংসের ইতিহাস শেষ করে গিবন লিখেছেন : ‘…and we may inquire, with anxious curiosity, whether Europe is still threatened with a repetition of those calamities which formerly oppressed the airns and institutions of Rome. Perhaps the same reflections will illustrate the fall of that mighty empire, and explain the probable causes of our actual security.’ এবং এই পরীক্ষার ফলে গিবনের মনে হয়েছে যে, তাঁর সমসাময়িক ইউরোপের রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থা মোটামুটি দৃঢ় ভিত্তির উপরই দাঁড়িয়ে আছে : ‘The abuses of tyranny are restrained by the mutual influence of fear and Shame; republics have acquired order and stability; monarchies have imbibed the principle of freedom, or at least of moderation.’ গিবন তাঁর ইতিহাস লিখে শেষ করেন ১৭৮৭ খ্রিস্টাব্দে, অর্থাৎ ফরাসি বিপ্লবের দু’বছর পূর্বে। তাঁর সমসাময়িক ইউরোপের সমাজ ও রাষ্ট্রের ভিত্তিমূলে যে বিপ্লবের আগ্নেয়গিরির পাথর-গলা আরম্ভ হয়েছে তার বিন্দুমাত্র সন্দেহ গিবনের মনে হয়নি। রোম-সাম্রাজ্য-ধ্বংসের ইতিহাস তাঁর বর্তমানের দৃষ্টিকে কিছুমাত্র তীক্ষতর করেনি। যে ঐতিহাসিক ইতিহাস-জ্ঞানের জোরে বর্তমানকে উপদেশ দিতে সাহস করেন তার একবার ভেবে দেখা ভাল যে, তার ঐতিহাসিক দৃষ্টি গিবনের চেয়ে সূক্ষ্মতর কি না।