- বইয়ের নামঃ প্রাচীন পূর্ববঙ্গ গীতিকা
- লেখকের নামঃ ক্ষিতীশচন্দ্র মৌলিক
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
মইষাল বন্ধু-সাঁজুতী কন্যার পালা
মইষাল বন্ধু-সাঁজুতী কন্যার পালা
ভূমিকা
মইষাল বন্ধু পালা মাননীয় দীনেশচন্দ্র সেন মহাশয় তাঁহার সম্পাদিত পূর্ববঙ্গ গীতিকা দ্বিতীয় খণ্ডে দুই প্রস্থে প্রকাশ করিয়াছেন, এবং ঘটনার অংশ বিশেষের বর্ণনাও দুই প্রকায়, অধিকন্তু তাহার দুইটি সংগ্রহই অসমাপ্ত ও সামঞ্জস্যহীন। এই সম্পাদনায় এক প্রস্থে সম্পূর্ণ পালা প্রকাশিত হইল।
এই সম্পাদনায় পালার ছাত্র সংখ্যা ৮০৬। ইহার ৫৮০ ছত্র সেন মহাশয়ের সংগ্রহে পাওয়া যাইবে, ২০৬টি ছত্র নূতন। সেন মহাশয় সম্পাদিত উক্ত ৫৮০ টি ছত্রের মধ্যে ৬৮টি ছত্রের সঙ্গে এই সম্পাদনার ছত্রের তাৎপর্যে পার্থক্য ঘটায় সেন মহাশয়ের পাঠ তৎতৎ স্থলেই পাদটীকায় দেওয়া হইল। আমার নূতন সংগ্রহ বুঝাইতে ছত্রের শেষে ‘+’ চিহ্ন দেওয়া হইয়াছে।
মাননীয় সেন মহাশয় সম্পাদিত পালার প্রথম প্রস্থে ঘটনা টী মধুরীর পরিচয় ঘটে নাই। বিবাহের পর স্নানের ঘাটে সাঁজুতীকে দেখিয়া লম্পট মছুয়া অসৎ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য ডিঙ্গাধরের গৃহে অতিথি হইয়া বন্ধুত্ব স্থাপন করে, এবং আড়ং-এর দেশ উত্তর পাটন-এ বাণিজ্যে প্রচুর লাভের প্রলোভন দেখায়। ইহার পরে সেন মহাশয়ের সম্পাদনার বর্ণনা—যাহা এই সম্পদনায় নাই, তাহা
এই সব শুনিয়া তবে সাধু ডিঙ্গাধর।
বাণিজ্য করিতে যায় উত্তর নগর।।
সাঁজুতী কন্যার কাছে লইয়া বিদায়।
ছয় মাসের পথ সাধু ছয় দিনে যায়।।
নগর নাগরীয়া যত বড় বড় দেশ।
কত না ছড়াইয়া চলে কহিতে সবিশেষ।।
সাম গুঞ্জরিয়া যায় ববি পাটে বসে।
উইড়্যাছে ডিঙ্গার পাল লীলুয়ারী বাতাসে।।
মনে বিষ মছুয়া কয় মাঝি মাল্লা গণে।
আইজ রাইতের লাইগা ডিঙ্গা বান্ধ এইখানে
খেলায় খেলুনী পাশা রাত্রি নিশি পাইয়া।
মধুয়ার নায়ে ডিঙ্গাধর পড়ে ঘুমাইয়া।।
তবেত দুষমণ মঘুষা কোন কাম করে।
কাটিয়া ডিঙ্গার কাছি ভাষায় সায়রে॥
সাধু লইয়া মধুয়ার ডিঙ্গা সুতে ভাইস্যা যায়।
ডিঙ্গাধরের মাঝিমাল্লা সুখে নিদ্রা যায়।।
ঠার পাইয়া মথুয়ার যত মাঝিমাল্লাগণ।
উজান সুতে উড়ায় পাল পৃষ্ঠেতে পবন।।
***
একেলা আছয়ে ঘরে সাঁজুতী সুন্দরী।
দুই চার দাসী তার আছে পাটুয়ারী।।
বিয়ান বেলা বুন্ধা আইস্যা খবর জানায়।
সাধুত আইস্যাছে ঘাটে শব্দ শুনা যায়।।
এই কথা শুনিয়া তবে ডিঙ্গাধরের নামী।
কোমরে বান্ধিয়া পরে ময়ুরপঙ্খী শারী।।
হাতেতে পরে তার-বাজু করিয়া যতন।
চম্পাফুল দিয়া কন্যা বান্ধিল লুটন।।
লুটনে তুলিয়া দিল সোনার ভোমরা।
কপালে কাটিয়া দিল সুবর্ণের তারা।।
নাকেতে বেশর দিল কানে ঝুকাফুল।
কপালে সিন্দুর দিল পক্ষী সমতুল।।
পায়ে দিল গোল খাড়, পঞ্চম গুঞ্জয়ী।
এই মতে সাজন করে ডিঙ্গাধরের নারী।।
ডালা সাজাইল কন্যা ধান্য দুর্বা দিয়া।
বনদুর্গার আগ লইল আইঞ্চল বান্ধিয়া।।
ছয় মাস পরে সাধু ফিরা আইল, দেশে।
ডিঙ্গা অর্গিবারে কন্যা চলিল বিশেষে।।
আপন ঘাটের ডিঙ্গা দেইখ্যা খুসী হইল।
ডিঙ্গা আনিবারে কন্যা ত্বরিতে চলিল।।
অর্গিয়া পুছিয়া ডিঙ্গা তুইল্যা লইব ধন।
হাটু জলে লাইম্যা কন্যা কোন কাম করিল।
ঘলুইয়ে সিন্দুর ফোটা ধান্য দুর্বা দিল।।
স্বামীত ফিরিয়া আইছে বহুদিন পরে
ভরা বুক হাসি খুসী মুখে নাহি ধরে।।
তবেত দুষমণ মধুয়া কোন কাম করে।
চিলে যেমত থাপা দিয়া কাটুনীর মাছ ধরে।।
হাতেতে ধরিয়া তুলে ডিঙ্গার উপরে।
ইঙ্গিত পাইয়া মাল্লা ডিঙ্গা দিল ছেড়ে।।
একে ত ভাটিয়াল পানি জোরে বয় হাওয়া।
পালেতে বান্ধিল বাতাস আশমানে ডাকে দেওয়া।।
দেখ দেখ না দেখ দেখ চলিল ভাসিয়া।
পারে থাইক্যা পারের লোক রহিল চাহিয়া।।
সাজুতা সুন্দরী কন্যা কান্দে থাপাইয়া মাথা।
রাক্ষসে হরিল যেমন জঙ্গলার সীতা।।
মাননীয় দীনেশচন্দ্র সেন মহাশয় পালাটির প্রথম প্রস্থ এইখানেই শেষ করিয়া মন্তব্য করিয়াছেন, পালাটি অসমাপ্ত রহিয়াছে।
পালাটি দ্বিতীয় প্রস্থের সঙ্গে আমার নিজ সংগ্রহের অধিকাংশ মিল আছে। মধ্যে মধ্যে আমার সংগ্রহে বেশী ছল আছে, এবং ঘটনার পারম্পর্য রক্ষার জন্য সেন মহাশয়ের সম্পাদিত ছত্রগুলি স্থানে স্থানে পূর্বাপর হইয়া গিয়াছে।
সেন মহাশয়ের সম্পাদনায় দ্বিতীয় প্রস্থের শেষের দিকে অসমাপ্ত ভাবে আছে–
কাঙ্গু রাজার বিচার কথা শুন দিয়া মন।
না জানি সুন্দর নারী দেখিতে কেমন।।
আরদালী পেদালী দুই ত্বরিত পাঠাইয়া।
মইনার সহিতে আনে ক্যারে ধরিরা।।
শূলের হুকুম হইল মইষালের উপরে।
এমন কালে সাঁজুতী কন্যা কোন কাম করে।।
*** ***
*** ***
ভাই হইয়া দুষমণ হইল…।
মইনার কানে কান্দে বনের পশু পক্ষী।
এই আটটি ছত্রের সঙ্গে ঘটনায় আমার সংগ্রহের মিল আছে এবং ইহার পর আমার সংগ্রহে ঘটনার পরিসমাপ্তি ৩৬টি নূতন ছত্র আছে।
সেন মহাশয় সম্পাদিত পালাটিতে কোনো কোনো স্থলে ছত্রের মইষাল বন্ধু-সাঁজুতী কন্যার পালা পরিবর্তে স্টার চিহ্ন থাকায় বুঝা যায়, ঐ সব জায়গায় আরও ছত্র আছে বলিয়া তিনিও সন্দেহ করিয়াছেন।
এই পালাটি আমি বহুবার শুনিয়াছি, পালাটি সঙ্গীতবহুল। ১৯৪২ খৃষ্টাব্দে হবিগঞ্জে পূর্ণ গায়েনের খাতা হইতে যে ভাবে পালাটি পাইয়াছি তাহাই এখানে দেওয়া হইল।